এক
মার্কেজের মেমারিজ অফ মাই মেলানকোলিক হোরস তার সেরা লেখাগুলোর মধ্যে পড়ে না নিশ্চয়ই, কিন্তু উপন্যাসের একটা লাইন আমার আট বছর ধরে মনে আছে। সংলাপটা ছিল বেশ্যালয়ের মালকিন রোসা-র গলায় : “আমি সব সময়েই বলে এসেছি যে ঈর্ষা সত্যের থেকে বেশি জানে”। প্রেমের উপন্যাস, তাই ঈর্ষা শব্দটা এসেছে। কিন্তু মনে হয় মার্কেজ একমত হবেন, এবং আপনারাও, যে ঘৃণা সত্যের থেকে বেশি জানে, বিদ্বেষ সত্যের থেকে বেশি জানে, অবিশ্বাস সত্যের থেকে বেশি জানে, সন্দেহ সত্যের থেকে বেশি জানে, প্রতিহিংসা সত্যের থেকে বেশি জানে। সব কিছু মিশে দাঁড়াল — অপ্রেম সত্যের থেকে বেশি জানে।
বলা বাহুল্য, সত্যের চেয়ে বেশি জানা মানে মিথ্যে জানা, ভুল জানা; যেমন এই উপন্যাসে লেখক তার অসমবয়সী প্রেমিকাকে ঈর্ষাকাতর হয়ে সন্দেহ করেন; পরে দ্যাখা যায় তার ধারণার সঙ্গে বাস্তবের কোনও যোগাযোগই নেই।
হয়তো এই অপ্রেম থেকেই ফোবিয়া জন্ম নেয়। ধরুন, কোনও মানুষের ট্রেন থেকে নির্দিষ্ট স্টেশানে নামতে পারা নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা আছে। সে পেছন থেকে সামনের সবাইকে ভয়াবহ ধাক্কা দিয়ে নেমে যাবে, যদিও সামনের লোকেরাও ওই স্টেশনে নামবে ব’লে তাকে আগেই জানিয়েছিল। লোকটার চোখের সামনে পরিসংখ্যান মেলে ধরুন — এই লাইনে ট্রেন থেকে ঠিক স্টেশানে না নামতে পারার ঘটনা হাজারে একটা। দুর্ঘটনার সম্ভাবনার কথা বলুন –– আপনার ধাক্কা খেয়ে কেউ প্ল্যাটফর্মের ওপর পড়ে দাঁতমুখ কাটতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিন — কাউকে অভদ্রভাবে ধাক্কা মারা উচিত নয়। তার ভেতরে কিছুই সেঁধোবে না।
সে বলবে : আগে আমিও তাই ভাবতাম, কিন্তু ওই ভদ্রতা মানবিকতা ইত্যাদি করতে গিয়ে একদিন নামতে পারিনি (খারাপ অভিজ্ঞতা)। শুনে মনে হবে, সেই ব্যর্থ দিনের পর থেকে স্টেশানে নামার কাজে তার যাবতীয় মারপিট আইনসম্মত হয়ে গেছে। এবং অন্যদের প্রতিবাদ করার অধিকারও নেই যেহেতু লোকটা একদিন সত্যিই স্টেশান ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিল যে! তার দ্বিতীয় যুক্তি হবে, সামনে থাকা প্যাসেঞ্জার বলে বটে স্টেশানে নামব, কিন্তু আসলে নামে না (অবিশ্বাস)। একই সঙ্গে জানাবে, সুমুখে দাঁড়ানো পাবলিক এত আস্তে আস্তে নামে যে ট্রেন ছেড়ে দেয় অথবা প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরা উঠে পড়ে (অযোগ্য জনতা)। সুতরাং, ধাক্কা মেরেই নামতে হবে (আক্রমণাত্মক আচরণ)। আপনি বলুন, পরিসংখ্যান শুনেও এত ভয় পাচ্ছেন যখন, একটু আগে সিট ছেড়ে উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়ালেই তো হয়! উত্তরে সম্ভবত লোকটা মুখ খারাপ করবে।
আমাদের মানসিক সমস্যাগুলো যে নানারকম চেহারা নেয়, তার একটা রূপ সাম্প্রদায়িকতা। ট্রেন থেকে নামার সময়ের আতংককে যদি ওই ভাষায় অনুবাদ করেন — আমি সংখ্যালঘু-প্রেমীই ছিলাম, কিন্তু আমার জীবনে অমুক ঘটনাটা ঘটার পর বা তমুক ঘটনা দেখে, পড়ে কিম্বা শুনে পালটে গেছি (খারাপ অভিজ্ঞতা)। ওরা ভারতকে ভালোবাসে না, একদিন দেশটা দখল ক’রে নেবে (অবিশ্বাস)। ওরা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান না প’ড়ে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যযুগীয় কথাবার্তা মেনে চলে (অযোগ্য জনতা)। কাজেই এদের উৎখাত করাই উচিত, অথবা দাবিয়ে রাখতে হবে (আক্রমণাত্মক আচরণ)।
এভাবে অপছন্দের অপর-কে একটা শ্রেণি বা দলে ফেলা হয় যাদের প্রত্যেকের চরিত্র একই রকম, আশাআকাঙ্খাও অভিন্ন। ধরুন, মুসলমান মানেই তেলাপিয়া মাছ বা দলিত মানে মৌরলা। (যেখানে মুসলমানেরা সংখ্যায় বেশি, তারা হিন্দুদের ফ্যাঁশা মাছ বলছে)। তেলাপিয়া তেলাপিয়াই, সাইজে ছোট বা বড় হতে পারে শুধু। এমন চিন্তার বিপজ্জনক সুবিধেটা হল, আপনাকে মাথা খাটাতে হবে না। পরীক্ষার হলে অংকের ফর্মুলা পাশ থেকে কেউ ফিসফিস ক’রে ব’লে দিচ্ছে। কোনও ধর্ম বা ইডিওলজি বা দলের অন্ধ অনুসরণ মানেই না-পড়ে লেটার নম্বর।
কেননা, এই সমীকরণ অনুযায়ী যদি দুটো শিখ একজন মেয়েকে ধর্ষণ ও খুন করে পালিয়ে যায় তবে অন্য যে-কোনও দুজন শিখকে ধরে এনে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে, যেহেতু ওরা একই সম্প্রদায়ের। দাঙ্গার যুক্তি, দাঙ্গার আদর্শ, দাঙ্গার গঠনতন্ত্র এটাই। টুপিতে-টুপিতে তিলকে-তিলকে বা পাগড়িতে-পাগড়িতে মিলে গেলেই একের প্রাপ্য সবক অন্যকে শিখিয়ে দাও। ধরুন, বাংলাদেশে আমার ঠাকুরদার জমি কোনও মুসলমান কেড়ে নিয়েছিল ব’লে আমি এদেশে মুসলমানদের তিষ্ঠোতে দেব না। আবার আমার ঠাকুরদাদার বাবা ওদের মানুষ জ্ঞান করত না — সেই রাগে কোনও মুসলিম হিন্দু দেখলেই তার সর্বনাশের প্ল্যান ভাঁজবে। ব্যক্তির ইতিহাসের এক ব্যক্তিগত ব্যাখ্যাই ঘৃণার প্রথম প্রেক্ষাপট। এইভাবে অনেক এককের অসম্পূর্ণ ইতিহাসসমীক্ষা জুড়তে জুড়তে দাঙ্গার মন তৈরি হয়।
কিন্তু যে ভালোবাসতে জানে সে ইতিহাস মনে রাখে না।
.
(পুরোনো পোস্ট)
loading...
loading...
আপনার লিখার জীবনবোধের অসম্ভব শৈলীর যেমন বর্ণনা থাকে, তা পড়তে বসলে মনযোগের এমন গভীরে ডুবে যেতে হয়, যে প্রতিটি লাইন থেকে যেন কোন শব্দ বাদ পড়ে না যায়। অসাধারণ লিখন প্রিয় চন্দন ভট্টাচার্য দা। শুভ সকাল।
loading...
ভিন্ন স্বাদের লেখা। ভালো লাগলো বেশ
loading...