করোনাকাল একদিন অস্ত যাবে। অন্ধকার ভেদ করে ফুটবে আলো। ‘পাখি সব করে রব’ রাত্রি পোহাবে। রাখাল আবার মাঠে যাবে, আর শিশুরা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে নিজ নিজ পাঠে মনোনিবেশ করবে। তাদের মনোনিবেশ আঁধারের ওপারে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাবে। করোনার বিসদৃশ সময়ের পরে পৃথিবী আবার পয়মন্তকালে পৌঁছাবে। পরিচিত পৃথিবী ফিরে আসবে। করোনার ছোবল চিহ্ন মুছে যাবে। ফিরে আসবে প্রাণময় পৃথিবী। করোনায় বিপর্যস্ত মানুষ আবার খুলে দেবে বুকের বোতাম। বন্দি জীবনের পাঠ শেষে গলা খুলে গাইবে মুক্তির গান, জীবনের গান। জীবনের নীচতা, ক্ষুদ্রতা, সংশয় পুনঃবিচার্য হবে। মানুষ ফিরবে হৃদয়ের কাছে। বিভ্রান্ত মানুষ হৃদয়ের ডাক শোনার চেষ্টা করবে। কারণ, যত যা-ই হোক না কেন, তবু পৃথিবী মানবিক।
মানুষ সব সময়ই মানবিক। মানুষের মাঝে মঙ্গলের আকুতি শতভাগ। শতভাগ মানুষ স্বচ্ছ এবং নির্মল। স্রষ্টা মানুষকে সদগুণে সৃষ্টি করেছেন। তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন মঙ্গলমন্ত্র। একে অপরের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, মমতা দেখানো মানুষের ধর্ম। সৃষ্টির শুরু থেকে মানুষ তাই করে আসছে। মানুষের এ পর্যন্ত পৌঁছানোর মূলে আছে এসব গুণ। না হলে মানব ইতিহাসের এত বড় পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হতো না। করোনা-উত্তর যে পৃথিবী, তার মূলে থাকবে মানুষের মঙ্গল আকুতি আর ভালোবাসা।
করোনাকালও আমাদের সেই দিকেই ধাবিত করছে, ক্ষণিকের বিভ্রান্ত মানুষ ফিরে আসছে মানবিক পাঠে। যদিও তাৎক্ষণিক ধারণায় কিছু বিপরীত চিত্র পাই কিন্তু এসব চিত্র সামগ্রিকতা ধারণ করে না। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে মানুষের মানবিকতা মাপা যায় না, মাপা উচিত না। কাচের ভাঙা টুকরায় প্রতিফলিত হয় না মানুষের প্রকৃত মুখ, মুখের প্রতিফলনের জন্য চাই সামগ্রিক আয়না। সময় ও সমাজকে বিচার করতে চাইলে বিচ্ছিন্নতার ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, পূর্ণাঙ্গ ছবির প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। সমুদ্রে হাঙর থাকে কিন্তু সমুদ্র মানেই হাঙ্গর না। আমাদের সমগ্র সমুদ্রকে বিবেচনায় নিতে হবে।
করোনার সময়ে কিছু অমানবিক চিত্র আমাদের সম্মুখে হাজির হয়েছে, কিছু কিছু ঘটনা মনোবেদনার কারণ হয়েছে। কিন্তু এসবের বিপরীতে যেসব ঘটনা, আমাদের মনযোগ, সেসবের প্রতি বেশি করে আলোকপাত করতে হবে।
যদিও সৃষ্টি মানুষের মানবিকতায় বিশ্বাসী তবু কিছুটা বৈচিত্র্য সে এড়াতে পারে না, সৃষ্টির সৌন্দর্যের জন্য কিছুটা ভিন্নতা দরকার হয়ে পড়ে। শুধু ভিন্নতা দিয়ে সৃষ্টিকে পরিমাপ করা ঠিক না, করলে অন্যায় হবে।
মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথা না বললেও হয়তো তেমনই থাকতো, নাড়ির বন্ধন থেকে কেউ নিশ্চয় মুক্তি চাইতো না। মা এবং সন্তানের মধ্যে ভালোবাসা ব্যাখ্যাতীত, কোনো হিসাবপত্র বা বাটখারায় মাপজোখ করার সুযোগ নেই। এই ভালোবাসায় সংশয়, ঈর্ষা, দ্বেষের কোনো স্থান নেই। স্বর্ণকার যদি শতভাগ সৎ থেকে খাঁটি সোনার অলংকার তৈরি করেন, তবুও তাতে কিছু খাদ থাকে। সোনার ধর্ম হচ্ছে খাদের, কারো সাথে মিশ্রণ ছাড়া সোনা অলংকারে রূপ নেয় না। পক্ষান্তরে মা ও সন্তানের ভালোবাসা অকৃত্রিম ও খাঁটি, বিন্দুমাত্র খাদ মেশানোর সুযোগ নেই।
করোনায় আক্রান্ত মাকে যখন তার নাড়িছেঁড়া সন্তান জঙ্গলে ফেলে যায় আমরা আঁতকে উঠি, অমানবিকতার চরম প্রকাশে দিশেহারা হয়ে যাই। করোনায় আক্রান্ত বাবার লাশ গ্রহণে সন্তান অসম্মতি জানালে আমরা বিমূঢ় হয়ে যাই, আমাদের বোধ বাইরে চলে যায়। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে যখন চলন্ত বাস থেকে যাত্রীকে নামিয়ে দেওয়া হয়, হত বিহবল আমরা অবিশ্বাসে নিজের আঙুল কামড়ে ধরি।
করোনায় আক্রান্ত একজন রোগী যখন স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে অন্যকে আক্রান্ত করার পরিকল্পনা করে, আমরা অবাক হই। এমন অমানবিকতা আমাদের বিশ্বাসকে দোদুল্যমান করে ফেলে, আমরা ভাবি এমন মানব জন্মের সত্যিই কি কোনো প্রয়োজন আছে!
মানুষের অমানবিকতা আমাদের আহত করে, যে বিশ্বাসে আমরা জীবনধারণ করছি সে বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। বিশ্বাসকে দুমড়েমুচড়ে দেয়। তবে জীবন পাঠে এমন ঘটনা যে দুর্লভ হবে না, সৃষ্টি আমাদের আগেই জানিয়ে দেয়। সৃষ্টি নিজেকে পরখ করার সুযোগ দেয়, আয়নায় নিজের প্রতিকৃতি দেখার সুযোগ দেয়।
মাকে ফেলে দেওয়া, বাবার লাশ গ্রহণে অসম্মত সন্তান কিংবা বাসভর্তি বিভ্রান্ত যাত্রীই একমাত্র সত্য নয়, সত্যের জন্য বিপরীতেও তাকাতে হবে। দৃষ্টি প্রসারিত করে সৃষ্টির খেলাকে আত্মস্থ করতে হবে। সময়ের সঠিক পরিমাপের জন্য অপেক্ষা করে সময়কে ধরতে হবে, বুঝতে হবে। সময় নিঙড়ে নির্যাসটুকু গ্রহণ করতে পারলে সময় সহায় হয়ে উঠবে। সময়ের পরিপূর্ণ চিত্র দৃশ্যমান হবে।
কোনো কিছুই সৃষ্টির কাছে অপূর্ণ থাকে না, সবকিছু সে পুশিয়ে দেয়। অমানবিকতার বিপরীতে সে এমন সব মানবিক দৃশ্য আমাদের সামনে হাজির করে যে আমরা চিৎকার করে বলে উঠি আমরা মানুষ, মানবিকতা আমাদের ধর্ম। এসব মানবিক দৃশ্য দেখে আমরা চিত্তানন্দে নেচে উঠি।
জঙ্গলে ফেলে যাওয়া মায়ের সন্তানের অভাব হয় না, অসংখ্য মানুষ পরম যত্নে মা’কে কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে যায়। করোনার ভয় তাদের দমাতে পারে না, মায়ের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয় তারা। নিজ সন্তানের কৃত অপরাধের জন্য মায়ের কাছে ক্ষমা চায়। অশ্রুঝরা মায়ের সামনে দাঁড়ানো হাজার সন্তান, এমন মাতৃভক্ত সন্তান যার আছে, করোনা তাকে কিভাবে পরাস্ত করবে? মা তার আশীর্বাদের হাত সন্তানদের মাথায় বুলিয়ে দেন।
ছেলেরা বাবার লাশ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে হাসপাতালে হাজির হয় অসংখ্য ছেলে। তারা নিজ কাঁধে বাবার লাশ বহন করে গোরস্থানে নিয়ে যায় পূর্ণ সম্মান এবং মর্যাদায়। দাফন বাবার লাশ। করোনা আতঙ্ক তাদের বিন্দুমাত্র ভাবিত করে না। যদিও এই ছেলেরা বাবার ঔরশজাত নয়, তবু বাবার শেষকৃত্যে কোনো কমতি রাখে না। এসব ছেলেরা বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠে। মৃত্যুপারে বাবা নিশ্চয় এমন ছেলেদের জন্য গর্বিত হচ্ছেন, ছেলেদের মঙ্গলের জন্য নিশ্চয়ই তার প্রার্থনার হাত উঠেছে।
বাসের সেই যাত্রী যখন অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অবিশ্বাসের চোখে চারদিকে তাকাচ্ছে, তখন এগিয়ে আসে পথিক। যাত্রীর অসহায়ত্বের কথা শুনে তার হৃদয় কেঁদে উঠে। নিজ উদ্যোগে অন্য গাড়ি যোগাড় করে, নিজে সহযাত্রী হয়ে বাড়ি পৌঁছে দেয়। করোনার ভয় সে পরোয়া করে না, মানুষের বিপদে সাড়া দিয়ে সে মনুষ্যত্বের দায়িত্ব পালন করে।
বাসের করোনা-ভীত যাত্রীরা নয়, এই পথিক আমাদের চিহ্ন। বাবার ঔরশজাত সন্তান বিভ্রান্ত হলেও হাসপাতালে হাজির হওয়া সন্তান আমাদের চিহ্ন। মায়ের ফেলে যাওয়া সন্তান অভাগা হলেও কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া সন্তানেরা মানবিকতার চিহ্ন।
আমরা এমন এক মানবিক পৃথিবীতে আছি যে পৃথিবী নিয়ে গর্ব করতে পারি। ৮৫ বছরের পিটার যখন ভেন্টিলেটরের স্বপ্লতা উপলব্ধি করে নিজের ভেন্টিলেটর ২৭ বছরের টমাসকে দিয়ে দেয় তখন আমাদের আকাশে মানবিক চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। পিটারের স্বেচ্ছা মৃত্যু ব্যথিত করলেও তার মানবিক প্রাণ আমাদের উজ্জীবিত করে।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে ঘর মেরামতের জন্য তিল তিল করে জমানো দশ হাজার টাকা যখন একজন ভিখারি মানবতার সেবায় দান করে দেন, তখন অশ্রু আটকানো যায় না, আমরা দেখি অন্ধকার ভেদ করে আসছে আলো। তাতে আলোকিত হচ্ছে মানুষের আকাশ। সেখানে ভাসছে এক মানবিক মানুষের মুখ। আমরা ভুলে যাই ভিখারির বুকেও একজন মানুষ থাকে, তিনি আমাদের ভুল ভাঙাতে মানুষ হয়ে দেখা দেন, তার মানবিকতায় মানুষের শির উঁচুতে পৌঁছায়।
মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও যে চিকিৎস, নার্স সেবা দিয়ে যাচ্ছে তারা আমাদের চিহ্ন। চালের বস্তা মাথায় করে যে জেলা প্রশাসক অসহায় মানুষের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি আমাদের চিহ্ন। মানুষের অসহায়ত্বে যে কোটিপতি নিজের লকার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি আমাদের চিহ্ন। অসহায় মানুষের অভাব দেখে যে জনপ্রতিনিধি রাতের আঁধারে কোনো ধরনের প্রচার না করে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন তিনি আমাদের চিহ্ন। প্যান্ট গুটিয়ে গায়ে কাঁদা মেখে যে চেয়ারম্যান কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন তিনি আমাদের চিহ্ন। নিজের নিরাপত্তা পরোয়া না করে যে পুলিশ, আর্মি ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন তারা আমাদের চিহ্ন। আমাদের চিহ্ন পাড়ায় সেই সব স্বেচ্ছাসেবক যারা অনিরাপদ জেনেও প্রতি ঘরে গিয়ে অভুক্ত মানুষের খোঁজ করছেন, প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। যে সিএনজি ড্রাইভার এক মাস কর্মহীন থাকার পরেও নিজের বরাদ্দ ত্রাণ অন্যকে দিয়ে দিচ্ছেন তিনি আমাদের চিহ্ন।
এমন মানুষের জন্য পৃথিবী। তাদের জন্যই পৃথিবীটা মানবিকও সুন্দর। আমরা সেই পৃথিবীর বাসিন্দা। ক্ষণিকের অন্ধকার আমাদের ভিন্ন দৃশ্যায়নে নিয়ে গেলেও মানবিক মানুষেরা আলোর সন্ধান দেয়। তাদের অনুসরণ করলে আলোকিত হওয়ার পথ পাওয়া যায়। সেই পথ ধরে পাওয়া যাবে মানবিকতার পৃথিবী।
loading...
loading...
মানুষের জন্য পৃথিবী। তাদের জন্যই পৃথিবীটা মানবিক ও সুন্দর। আমরা সেই পৃথিবীর বাসিন্দা। ক্ষণিকের অন্ধকার আমাদের ভিন্ন দৃশ্যায়নে নিয়ে গেলেও মানবিক মানুষেরা আলোর সন্ধান দেয়। তাদের অনুসরণ করলে আলোকিত হওয়ার পথ পাওয়া যায়। সেই পথ ধরে পাওয়া যাবে মানবিকতার পৃথিবী।
loading...
বাহ্ চমৎকার উপস্থাপন
loading...
"মানুষ সব সময়ই মানবিক। মানুষের মাঝে মঙ্গলের আকুতি শতভাগ। শতভাগ মানুষ স্বচ্ছ এবং নির্মল। স্রষ্টা মানুষকে সদগুণে সৃষ্টি করেছেন। তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন মঙ্গলমন্ত্র।"
সেই মন্ত্র ভুলে গিয়েই একসময় মানুষ বেঈমান শয়তান রূপে পরিণত হয়। আমি এমন অনেক শয়তান নিজের চোখে দেখেছি।
লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লেগেছে। শুভকামনা থাকলো।
loading...