আমি রেলওয়ের পরিত্যক্ত একটি কামরা। জীবনের প্রায় ৪০ টা বছর তোমাদের সঙ্গী হয়ে আজ আমি পরিত্যক্ত। শেষ ঠাঁই হয়েছে রেলওয়ের পুরোনো কলোনির বাম পাশটার অশ্বথের ছায়ায়। অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকতে থাকতে আমার পুরো শরীর জুড়ে নানান আগাছা জন্মেছে। শরীরটার বাদামী জং তো সেই কবেই ধরে গেছে। জীবনের ৪০ টা বছর শুধু দেখেই গেলাম কিছুই বলার ক্ষমতা হয়নি।
আমি তোমাদের মত মানুষ হলে কত কথাই না কইতাম! কিন্তু আমার কি আর সেই কপাল…জন্মেছি রেলের কামরা হয়ে। তখন থেকেই চলেছি তো চলছিই… তেপান্তের মাঠ ভেদ করে তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবার জন্যইু আমার এ যাত্রা। অনন্ত অসীমের পানে আমার যাত্রা নয়.. এ যাত্রা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে.. চাইলেও কখনো লোহার দু লাইনের বাইরে চলতে পারিনি.. যৌবনের প্রথম দিকে নিজেকে নিয়ে প্রচন্ড আত্ম অহংকারে বুক ফুলে উঠতো.. আমি লোহার তৈরী।আমি অবিনশ্বর! কিন্তু জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অনুভব করলাম.. ধুলোর পৃথিবীর সবকিছুই নশ্বর। তাই সেই লোহার তৈরী আমিই জং ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়ছি….
রেলের ইঞ্জিনের সাথে সাথে হুংকার তুলে আমি চলেছি স্টেশনের পর স্টেশন মাঝে মধ্যে হয়তো ১০/১৫ মিনিটের জন্য জিরোনোর সময় হয়েছে.. কিন্তু তারপর আবারো সেই ছুটে চলা… কি দিন কি রাত! আমি ছুটছি স্টেশনের পর স্টেশনে…জীবন থেকে জীবনে…. আমার সেই চল্লিশ বছরের যাত্রায় কত লক্ষ-কোটি মানুষকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছি তার ইয়াত্তা নেই।
মানুষের জীবনটাকে আরো কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে আমার। কখনো বা বাবা মা সন্তানের ভালোবাসা ছোঁয়ার স্বর্গীয় অনুভূতি তে ভরে উঠেছিলো চারদিক, বা বৃদ্ধ মায়ের ছেলের সাথে প্রথম শহর দেখার গল্প টার রচনা আমারই বুকে.. শুধু কি তাই? সেই নবীন নবীনার গল্প যারা ঘর বাঁধার স্বপ্নে পাড়ি দিচ্ছিল অন্য কোন শহরে.. সেসব গল্পগুলোও খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি। অন্ধ ভিক্ষুককে আমার বুকে ভিক্ষা করতে দেখেছি … আবার হাজারো হকার/ ফেরিওয়ালাকে আমার মধ্যে দু’চার টাকার এটা সেটা বিক্রি করে দু মুঠো খাবার জোগাড় করতে দেখেছি.. অনাহারে পড়ে মরে যাবার স্মৃতিতে যখন চোখ পানিতে টইটম্বুর হওয়ার উপক্রম হয়েছে.. তখন আমি নিজের অশ্রুকে সামাল দিয়ে আবারো ছুটতে শুরু করেছি.. আমার কাজ তো কেবল ছুটে চলা.. আমি যে জড়.. আমার দুঃখ পেলে চলবে!
কখনো সখনো আমারই চাকার নিচে পড়ে জীবনের সমাপ্তিও আমাকে দেখতে হয়েছে, রেলের চাকায় কাটা লাশের রক্ত ছুটে পড়েছে আমার গায়ে, তবুও আমার থামার ক্ষমতা নেই.. আমাকে যে চলতেই হবে.. জীবনের সুচনা থেকে জীবনের অন্তিমযাত্রা.. সবকিছুই দেখবার সৌভাগ্য বলি কিংবা দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছে আমার।
৪০ বছরের জীবনের সবথেকে বড় ট্রাজেডি কী তা জানো? বয়স যখন ১৬ তখন আমার শরীরে আগুন লেগে ভয়াবহভাবে পুড়ে যায় আমার শরীর সেই আগুনের লেলিহান শিখায় কতজন মানুষের পুড়ে যাওয়া দেখেছি.. সে আর মনেও করতে চাই না। বেঁচে থাকবার শেষ আকুতি যে কেমন হতে পারে সেটা দেখলে যেকউ বোবা হয়ে যেত..vকিন্তু আমি তো জন্মেছিই বোবা হয়ে..আর আবারো ছুটে চলেছি.. শহর থেকে শহরে মাঠ থেকে মাঠে..
আমার তো জীবনের পরিসমাপ্তির পথে.. জীবনের শেষ পর্যােয়ে এস আমার উপলব্ধি… মানুষ হয়ে না জন্মেই ভালো হয়েছে.. নয়তো হিংসে হানাহানি- খুনোখুনিতে জীবনের রঙটুকুও মলিন হয়ে যেত.. রেলের কামরা হয়ে জন্মেছি.. ভালোই তো আছি.. বাকি জীবনটুকুও এভাবেই কেটে যাবে…
–শামস আল গালিব
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
loading...
loading...
Rমানুষের জীবন এমন বৃদ্ধ হলে ছুড়ে ফেলে সন্তান । এখনতো মা বাবাকে হত্যাও করে সম্পত্তির জন্য
loading...
চমৎকার
loading...
অসাধারণ মানের একটি লিখা।
loading...