বর্তমান সময়ে ফেসবুকের কারিগরি সিস্টেমের সাথে কিছু জ্ঞানীগুণী ও কিছু অসাধু প্রতারক ব্যবহারকারীদের তেলেসমাতি দেখে যেমন অবাক হই, তেমন আবার ভাবতেও থাকি! ভাবনার কারণ হলো, আমার ফিরে দেখা ১৯৭৩-৭৪ সাল ও ২০১১-১২ সালে ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ নিয়ে এবং তখন কী দেখেছি আর এখন কী দেখছি তা নিয়ে।
১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে যখন এদেশে মোবাইল ফোন ছিলোই না, তখন এদেশে মোবাইল ফোনের নামও কেউ জানতো না। আর এখন দেশের আনাচে-কানাচের রাজপ্রাসাদে, বস্তিবাসীর হাতে উন্নতমানের নামী-দামী ব্যান্ডের টাচ্ স্ক্রিন এন্ড্রয়েড মোবাইল। এসব মোবাইলে রয়েছে দ্রুতগতির 4G ইন্টারনেট সুবিধা-সহ আরও কতকিছু! সবকিছুর মধ্যে তেলেসমাতি সুবিধা হলো, দ্রুতগতির ইন্টারনেট সুবিধা। এই ইন্টারনেট সুবিধা পেয়ে ধনী-গরিব সবাই বাজার থেকে একটা দামী অথবা কমদামি মোবাইল কিনেই ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করে দিন-রাত ফেসবুক নিয়েই পড়ে থাকে। কি ধনী আর কি গরিব, কি ছেলে আর কি বুড়ো; সবাই এখন ইমু, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও ফেসবুক নিয়েই অস্থির সময় পাড় করছে।
আবার কিছু জ্ঞানীগুণী ও কিছু অসাধু ব্যবহারকারীরা ফেসবুকটাকে তাদের দখলে নিয়ে গেছে। যদিও পুরোপুরিভাবে দখলে নিয়ে পারেনি, তবুও তাদের প্রাণপণ চেষ্টা অব্যাহত আছে। তাই ফেসবুকে থাকা এসব জ্ঞানীগুণী ও অসাধু ফালতু ব্যবহারকারীদের তেলেসমাতি সত্যি আমাকে ভাবিয়ে তুলে। ভেবেও কোনও লাভ হবে না বলে জানি! কারণ দিন যত গত হচ্ছে, নিত্যনতুন নামী-দামী ব্যান্ডের এন্ড্রয়েড মোবাইল এদেশের বাজারে আসছে। তাই খুব সহজেই যেকেউ একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল থেকে অনায়াসে ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করে তেলেসমাতি দেখিয়ে যাচ্ছে। তেলেসমাতি দেখাতে পারতোই না, যদি এন্ড্রয়েড মোবাইল এদেশের বাজারে না আসতো; আর হাতে হাতে এন্ড্রয়েড মোবাইল না থাকতো।
এসব দেখে মনে পড়ে, একসময়ের বাটন মোবাইলের কথা! এদেশে যখন মোবাইল ফোন বাজারে আসে, তখন বেশিদামী আর কমদামী সব ব্যান্ডের সব মোবাইলই বাটন মোবাইল ছিলো। বাটন মোবাইলে ইন্টারনেট সুবিধা বলতে GPRS কচ্ছপ গতির 2G ইন্টারনেট ছিলো। সেই কচ্ছপ গতির ইন্টারনেট সুবিধাতেও একসময় মানুষ বর্তমান যুগের অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করতো। কিন্তু ফেসবুকে এতএত তেলেসমাতি কারিগরি সিস্টেম আর এতো জ্ঞানীগুণীদের পদচারণা ছিলো না। ছিলো না, ভুয়া আইডির অসাধু ব্যবহারকারীদের আনাগোনাও।
সেই সময়কার বাটন মোবাইলে GPRS 2G ইন্টারনেট ব্যবহার করেই ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফেসবুকে রেজিস্ট্রেশন করেছিলাম। যা এদেশে ফেসবুক আবির্ভাব হবারও অনেক পরে। তা-ও একসময় হঠাৎ করে ওই আইডি টা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। শত চেষ্টা করেও ফেসবুকের প্রথম আইডি টা আর সক্রিয় করতে পারিনি। তারপর বাধ্য হয়ে ২০১২ সালে পুনরায় বর্তমানে চলমান আইডি টা খুলেছিলাম। কিন্তু বাটন মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করে এখনকার মতো এমন মজা পেতাম না। বাটন মোবাইলে ফেসবুক ব্যবহার করা মানে, মানুষ হয়ে গরুর মতো মাঠের ঘাস খাওয়া।
যাই হোক, ২০১১-১২ সালে যখন ফেসবুক ব্যবহার করতাম, তখন ফেসবুকের এতো কারিগরি সিস্টেম ছিলো না। যা ছিলো, তা শুধু একে অপরের সাথে সামাজিক যোগাযোগই রক্ষা করতে পারতো। যেমন– নিজের পছন্দের ছবি দিতে পারতো। নিজের টাইম লাইনে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে কিছু লিখতে পারতো। সীমিত শব্দের বার্তা প্রেরণ করা পারতো। তাই মনে হয় বর্তমান ফেসবুক একসময় বিশ্ববাসীর কাছে অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইট হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। আগে ফেসবুকে ভিডিও আপলোড করার সিস্টেম ছিলো না। ভিডিও লাইভ নামের কোনকিছুই ছিলো না। ভিডিও পোস্ট করার কোনও অপশন ফেসবুকে ছিলো না। কারোর কাছে ভিডিও কল তো দূরের কথা, কথা বলারও কোনও সুবিধা ছিলো না। মোটকথা মেসেঞ্জার সফটওয়্যার বা অ্যাপই ছিলো না। আর এখন? এখন ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ ভিডিও কলের জ্বালায় রাতের ঘুম হারাম।
আমি প্রথম যখন ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলাম, তখন দেখেছি এদেশের অনেক সাধারণ মানুষ-সহ অসংখ্য খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গরা এই ফেসবুককে আঁড়চোখে দেখতো। মানে, দেশের জ্ঞানী-গুণীরা অনলাইনে থাকা ফেসবুককে অপছন্দের একটা সাইট হিসেবে বিবেচনায় রাখতো। আবার অনেকের ধারণা ছিলো, এই ফেসবুক অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অনলাইন থেকে হারিয়ে যাবে। সেই ধারণা নিয়েই দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিরা আগে ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেনি। এমনকি ফেসবুকে একটু চুপিও দেয়নি। যদিও কোনও খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করেছিলো, তা কেবল পরিচিত ব্যক্তিদের ফেসবুকে ফলোআপ করার জন্যই করেছিলো।
নামী-দামী ব্যক্তিবর্গরা ফেসবুকে রেজিষ্ট্রেশন করার পর তাদের নিজের আসল নামটাও দেয়নি। তারা ফেসবুকে আত্মপ্রকাশ করেছিল ছদ্মনামে, আর প্রোফাইল ছবিটি সাজিয়ে রেখেছিল নানান রঙে। যেমন– ফুলের ছবি, গাছে ছবি, পাখির ছবি, ফলের ছবি, গরুর ছবি, ছাগলের ছবি, লাঠির ছবি, লতা-পাতার ছবি ইত্যাদি দিয়ে প্রোফাইল ছবির জায়গাটা ঠেসে রেখেছিল। প্রোফাইল ছবি আর নিজের নাম আড়ালে রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, অনেকেরই মনের ভয়। সম্মানহানির ভয়। অপমানের ভয়। লোকলজ্জার ভয়। বহু লোকের মাঝে পরিচিতির ভয়। এই ভয় থেকে এখনো অনেক নামী-দামী কবি, সাহিত্যিক, বড়সড় ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাদের দেখাদেখি অসংখ্য অসাধু ব্যবহারকারীরাও তাদেরই পথ অবলম্বন করছে।
একসময়ে ফেসবুককে অপছন্দকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলো কবি, সাহিত্যিক, লেখক/লেখিকা, বড়সড় ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা ও অসংখ্য অসংখ্য শিক্ষক/শিক্ষিকা ও শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ। ওনারা সবসময়ই ফেসবুকে থেকে যাচ্ছে আড়ালে আবডালে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের মতো উনারাও ফেসবুক ব্যবহারকারী। তবে মজার ব্যাপার হলো, এখন আর তাদের কাছে ফেসবুক অপছন্দের নয়! এখন ফেসবুক তাদের কাছে জীবন চলার চাবিকাঠি এবং সকালের নাস্তা, রাতের ঘুম। মোটকথা বাংলাদেশের ফেসবুক এখন তাদেরই দখলে।
সম্মানিত ব্যক্তিবর্গরা এখন ফেসবুকে গ্রুপ বা পেইজ তৈরি করে সাধারণ ব্যবহারকারীদের যোগদানের আহবানও জানায়। যেসব কবিগণ আগে ফেসবুকের নামও শুনতে পারতো না, উনারা এখন কবিতার আসর জমিয়ে, তাঁদের লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়ার অনুরোধ করে। আবার বড়সড় খ্যাতিমান সাহিত্যিকরা তাদের নিজস্ব গ্রুপে সাহিত্যচর্চার আসরও বসিয়েছে। বই প্রকাশনার প্রশাসকরা তাদের ই-মেইল ঠিকানায় লেখা পাঠানোর আহবান জানাচ্ছে। ছোট-বড় রাজনৈতিক নেত্রী বৃন্দরা তাদের অনুসারী বাড়ানোর জন্য ফেসবুকে আইডি খুলে নিজের পরিচয় জানান দিচ্ছে। আবার অনেক অসাধু ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের নামে ফেইক আইডি খুলে হাতে ইশারা দিচ্ছে, আমি অমুক, আমি অমুক!
তাই এখন ফেসবুকে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত নির্বাচনী প্রচারণাও চলে। এখন ফেসবুকে দেশের যেকোনো নির্বাচনের নির্বাচনী এলাকার পছন্দের প্রার্থীর একনিষ্ঠ কর্মীরা মিছিলও করছে, আমার ভাই তোমার ভাই, 'কেয়ামত ভাই, কেয়ামত ভাই। কেয়ামত ভাইয়ে চায় কী, কেয়ামত ছাড়া আর কী!
আবার অনেক জ্ঞানী গুণী দীর্ঘদিন ফেসবুককে অবহেলা করে ফেসবুক থেকে দূরে থেকে আফসোস করেও মরছে। তাই উপায়ন্তর না দেখে উনারা এখন ফেসবুকে আইডি খুলে প্রথমেই জানিয়ে দিচ্ছে, আমি কবি, আমি সাহিত্যিক, আমি রাষ্ট্রের এটা, আমি ওটা, আমি সেটা, আমি অমুক, আমি তমুক। এর মানে হলো, উনি অনেক দেরি করে ফেসবুকে এসে একদিনেই সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মন জয় করে ফেলতে চাইছে।
আবার অনেক বড়-বড় কবিরা একটু দেরি করে এসে, নিজের লেখা কবিতা-সহ দিন-রাত পারিবারিক ছবি আপলোড করেই যাচ্ছে। তাদের কাছে ফেসবুক এখন মহামূল্যবান এক সম্পদে পরিণত হয়েছে। অনেকেই আছে প্রতিদিন একবার করে নিজের প্রোফাইল ছবি-সহ কাভার ছবিও পরিবর্তন করছেই। এসব দেখে বোঝা যায়, উনারা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে সারাদিন এই ফেসবুক নিয়েই বসে থাকে।
বর্তমান ফেসবুক পাগল জ্ঞানীগুণীদের সাথে তাল মিলিয়ে অসাধু কিছু ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও এরকমই করছে। তবে অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কার্যকলাপ ভিন্নরকম। তারা এক-এক সময় এক-এক অপকর্মে ব্যস্ত থাকে। যেমন–কাউকে ঘায়েল করতে হলে ধর্ম অবমাননাকর একটা পোস্ট প্রতিপক্ষের ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আবার কারোর পোস্টে গিয়ে খামোখা বাজে মন্তব্য করে সমালোচনার জন্ম দিয়ে ভালো মানুষের ক্ষতি করবে। কারোর সামনাসামনি না পারলেও ফেসবুক হুমকি-ধমকি দিয়ে যাবে। আবার কোনও জনপ্রিয় নেতা-নেত্রীর ভালো কাজের গুনগান তারা গাইবে না। বরং ওইসব জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনা করা-সহ দোষ দিবে, নিন্দা করবে, মিথ্যে অপবাদ দিবে এবং যেভাবেই হোক হেয় প্রতিপন্ন করাই হলো ওইসব অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রতিদিনের কর্ম।
তাদের ওইসব কীর্তিকলাপ দেখে ভাবতে থাকি, যদি গুগল প্লাসের মতো কোনোএক সময় এই ফেসবুক চিরতরে হারিয়ে যায়, তাহলে ফেসবুকে দেরি করে আসা এসব কবি, সাহিত্যিক, লেখক/লেখিকা, জ্ঞানীগুণী আর অসাধু ব্যবহারকারীরা কী করবে? মনে হয় হার্ট-অ্যাটার্ক করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। কামনা করি তা যেন না হয়। সবাই বেঁচে থাকুক! সবাই ফেসবুকের নিয়মনীতি মেনে ফেসবুক ব্যবহার করুক! জয়তু ফেসবুক।
loading...
loading...
সবাই বেঁচে থাকুক! সবাই ফেসবুকের নিয়মনীতি মেনে ফেসবুক ব্যবহার করুক!
জয়তু ফেসবুক।
আপনার এই আবাহনের সাথে আমিও একমত মি. নিতাই বাবু। প্রযুক্তির সুব্যবহার নিশ্চিত হোক এটাই কামনা করি। অতি ব্যবহার সব কিছুকেই ম্রিয়মাণ করে ফেলে।
loading...
আমিও আপনার সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই, সবাই যেন অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাইটগুলো সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করে।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা। সাথে একটি প্রিয় গান।
loading...
যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ, সুন্দর হয়েছে।
loading...
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি শ্রদ্ধেয় দাদা। শুভকামনা থাকলো।
loading...
একবার পড়েছিলাম আবার পড়লাম
loading...
পড়েছেন জেনে অন্তত খুশি হলাম, দাদা। শুভকামনা থাকলো।
loading...