জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (দ্বিতীয় পর্ব)

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীজি (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্য-সংগ্রহ ও প্রবন্ধ রচনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে……

শুরুর দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের চিকিৎসাকেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেন। ভাগ্যের ফেরে গান্ধী একটি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে দেনা আদায়কারীর চাকুরি পেয়ে যান। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিটিশ এবং ডাচ শাসনাধীন। ভারতীয়রা সংখ্যালঘু হওয়ায় বর্ণ বৈষম্যের শিকার হত। গান্ধী বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন এবং সত্যাগ্রহের ধারণা সেখান থেকেই শুরু। যে ঘটনাটি গান্ধীর ভেতরকার নেতৃত্বের আগুনটি জ্বালিয়ে দেয় –

• ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট থাকা সত্ত্বেও তাকে কালো এবং ভারতীয় বলে ফার্স্ট ক্লাস কামরায় বসতে তো দেয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে বিবাদ করায় তাকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। এই ঘটনাটি গান্ধীর মনে দাগ কেটেছিল।

স্বদেশী আন্দোলনের সময় সকল বিদেশী পণ্য বিশেষত ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা হয়। এর পথ ধরে তিনি সকল ভারতীয়কে ব্রিটিশ পোশাকের বদলে খাদি পরার আহ্বান জানান। তিনি সকল ভারতীয় পুরুষ ও মহিলা, ধনী ও গরিব মানুষকে দৈনিক খাদীর চাকা ঘুরানোর মাধ্যমে স্বাধীনতার আন্দোলনকে সমর্থন করতে বলেন। এটি এমন একটি কৌশল ছিল যা নিয়মানুবর্তিতা ও আত্মত্যাগের অনুশীলনের মাধ্যমে অনিচ্ছা ও উচ্চাকাঙ্খা দূরীকরণের পাশাপাশি আন্দোলনে মহিলাদের যুক্ত করে, এ সময়ে মহিলাদের করা এ সকল কাজকে অসম্মানজনক বলে মনে করা হত।
লবণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করায় গান্ধী হাজার হাজার ভারতীয়দের সাথে পায়ে হেঁটে ডান্ডির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ইতিহাস একে Salt March বলে থাকে। শুধু মাত্র নিজ হাতে লবণ তৈরির জন্য পায়ে হেঁটে ১২ই মার্চ থেকে ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি পৌছান। এলাহাবাদ থেকে ডান্ডি প্রায় ২৪১ মাইল। সে সময় ব্রিটিশরাজ সেই অপমানের বদলা নিতে ৬০,০০০ ভারতীয়কে গ্রেপ্তার করে। ৬০,০০০ ভারতীয়!

হাঁটা নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গান্ধী জীবনে এত হেঁটেছেন যে তাতে পুরো পৃথিবী দুইবার চক্কর দেয়া সম্ভব। অর্থাৎ দিনে প্রায় ১৮ কিলোমিটার করে হাঁটতেন তিনি।

গান্ধী তার জীবদ্দশায় দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে সব মিলিয়ে ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় সাজার আদেশ পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে Young India পত্রিকায় ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী আর্টিকেল লেখার জন্য তাকে ৬ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ১৯২৪ সালেই মুক্তি দেয়া হয়।

গান্ধী আমেরিকা যাননি কখনো। তিনি মনে করতেন, তিনি যেহেতু জাতির পিতা (ভারতীয়রা গান্ধীকে বাপু বলে ডাকতেন), জাতির অধিকাংশ মানুষই গরিব, সেই গরিবের পিতা হয়ে তিনি কিভাবে বিমান ভ্রমণ করবেন? দেশ বিদেশে গান্ধীর অনেক ভক্ত তৈরি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হেনরি ফোরড ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম গান্ধী যাকে নিজের সাক্ষরযুক্ত একটি চরকা উপহার দিয়েছিলেন।

গান্ধী নিয়মিত তলস্তয়কে চিঠি লিখতেন। হিটলারের সাথেও বেশ চিঠি চালাচালি দেখা গিয়েছিল। যুদ্ধ বন্ধের অনুরোধ করে গান্ধী হিটলারকে একটি চিঠি লিখলেও তা আর হিটলারের কাছে পৌছায়নি। কারণ ব্রিটিশ সরকার এতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন।

আমরা ভালো কাজকে পুরস্কৃত করে থাকি। কিন্তু কিছু কিছু কর্ম থাকে, কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সকল পুরস্কারের ঊর্ধ্বে, বরং পুরষ্কার তাদের মহৎ কর্মকে খাটো করে। গান্ধী হলেন তেমনি পুরস্কারের ঊর্ধ্বের মানুষ। যাকে নোবেল কমিটি ৫ বার নোবেল মনোনয়ন দিয়েছিল। ১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯ এবং ১৯৪৭ সালে মনোনয়ন দিলেও ১৯৪৮ সালে শান্তিতে নোবেল গান্ধিরই পাবার কথা ছিল। কিন্তু ২ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে মৃত্যু হওয়ায় গান্ধীকে পুরষ্কার দিয়ে খাটো করা যায়নি।

যে দেশের বিরুদ্ধে গান্ধী সারাজীবন যুদ্ধ করেছিলেন সেই গ্রেট ব্রিটেন তার মৃত্যুর ২১ বছর পর তার সম্মানার্থে স্ট্যাম্পে গান্ধীর ছবি ছাপায়।

গান্ধীর সম্মানে ভারতে ৫৩ টি বড় রাস্তা এবং সারা পৃথিবী জুড়ে ৪৮ টি রাস্তার নামকরণ করা হয় গান্ধীর নামে। শুধু তাই নয়, Time Magazine এর Man of the Year 1930 হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
1948 সালের 30 শে জানুয়ারি নাথুরাম গডসে ব্ল্যাক পয়েন্ট রেঞ্জ থেকে মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো হত্যা করার পর নাথুরাম গডসে সেখান থেকে পালানোর কোন চেষ্টাই করেনি। কারণ সে চেয়েছিল তার এই জঘন্যতম হত্যার কথা সারা দেশবাসী যাতে জানতে পারে। এবার আপনাদের যেটা জানাবো সেটা অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। গান্ধীজী কে হত্যা করার জন্য তিনি একটা নয় দুটো নয় মোট 150 টি কারণ দেখিয়েছিল।

তবে সেই সময় কংগ্রেস সরকার এই সমস্ত কারণগুলি প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি। কিন্তু নাথুরামের দাদা গোপাল গডসের দীর্ঘতম আইনি লড়াইয়ের পর তা প্রকাশ পায়। গান্ধীজী কে হত্যা করার পেছনে নাথুরাম গডসে জেড এর সঠিক কারণ তুলে ধরা হয়েছিল তার মধ্যে সবগুলি এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তাই দশটি উল্লেখযোগ্য কারণ দেওয়া হলো।

1. 1919 সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের মূল জেনারেল ডায়ারের গোটা দেশ শাস্তি চেয়েছিল। কিন্তু গান্ধী সেই দাবি খারিজ করেন।
2. ভারতবাসী চেয়েছিল যে বিপ্লবী ভগৎ সিং এবং সুখদেবের ফাঁসি আটকানোর জন্য গান্ধী কিছু পদক্ষেপ করুক। কিন্তু এই সব কিছু তিনি করেননি। উল্টা আবার গান্ধী বলেন, এরা পথ ভ্রষ্ট বিপ্লবী, এরা যে পথে হাঁটছিল সেগুলি সন্ত্রাসের পথ, তাদের ফাঁসি তিনি আটকাবেন না।
3. 1986 সালের 6 ই মে যখন দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে সেই সময় গান্ধী হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেন যে তারা যেন মুসলিম লিগের লোকের বিরুদ্ধে যেন না লড়াই করে। সেই সময় মুসলিম লীগের লোকেরা কেরালায় প্রায় 1500 হিন্দুকে হত্যা করেছিল। এছাড়া আরও 2000 হিন্দুকে জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করানো হয়।
4. কাশ্মীরের রাজা হরি সিংকে কাশ্মীর ছেড়ে দিতে বলেন গান্ধী। কারণ কাশ্মীরে মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।
5. অনেকবার ভারতের মহান যোদ্ধা শিবাজী মহারাজ, রানা প্রতাপ এবং গুরু গোবিন্দ সিং কে পথ ভ্রষ্ট ভারতীয় বলেছিলেন গান্ধী।
6. ত্রিপুরা কংগ্রেস অধিবেশনে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধী নিজের ক্ষমতা বলে নিজের অনুগত পট্টভি সিতারামাইয়াকে কংগ্রেসের সভাপতি করেন।
7. 1947 সালের 15 ই আগস্ট কংগ্রেস সরকার ঠিক করে যে তারা ভারত বিভাজনের বিরোধীতা করবে। তবে যে সভাতে এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে সেই সভাতে গান্ধী একদম শেষ সময়ে পৌঁছান এবং দেশভাগের বিষয়টিকে তিনি সমর্থন করেন। এর আগে গান্ধী নিজেই বলেছিলেন দেশ ভাগ তার নিজের লাশের উপর দিয়ে হবে।
8. ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর সর্দার প্যাটেল প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীর নির্দেশে নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়।
9. এরপর নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে ভারত সরকার সোমনাথ মন্দির আবার নির্মাণ করবেন, কিন্তু সেই সময় গান্ধী সরকারে না থাকা সত্ত্বেও সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করান। আবার ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ 1948 সালের 13 জানুয়ারি তিনি দিল্লির মসজিদ যাতে সরকারি টাকায় নির্মাণ করা হয় তার জন্য তিনি অনশনে বসেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তার দাবি মানতে বাধ্য করান সরকারকে।
10.1947 সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা করলে গান্ধী আবার ভারত সরকারের বিরুদ্ধেই অনশনে বসেন। এর ফলস্বরূপ ভারত সরকার পাকিস্তানকে 55 কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। গান্ধীর এমন সিদ্ধান্ত দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সেই সময় ভারতের মুসলিমদের খুশি করতে হিন্দুদের নানা ভাবে প্রতারিত করেছেন তিনি।

সর্বশেষে নাথুরাম গডসে এবং তার সঙ্গে নারায়ণা আপ্তেকে 1949 সালের 15 ই নভেম্বর পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে দুজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। উপরের এই মন্তব্যগুলি নাথুরাম গডসে আদালতে করেছিলেন।

গান্ধীর শেষকৃত্যে ১০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল যা প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হয়েছিল। কেন মানুষ ভালবাসবে না এমন মানুষকে?

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৩-১০-২০২০ | ২১:৫৪ |

    শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ মি. ভাণ্ডারী।

    GD Star Rating
    loading...
    • টেক প্রশাসক : ০৪-১০-২০২০ | ১২:১২ |

      পরীক্ষা মুলক মন্তব্য Trumpet

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৪-১০-২০২০ | ২১:২৩ |

    শ্রদ্ধা।

    GD Star Rating
    loading...