দুয়ারে_আইসাছে_পালকি_১১

ঝগড়াটা না হলেও পারতো
এমন কোন মারাত্মক বিষয় ছিল না
মামুলি বিয়ের দাওয়াতের ঝগড়া
এ পর্যন্ত গড়াবে, জীবন বদলে দেবে
জীবন ধ্বংস করে দেবে, একটা জীবনের বাতি
নিভিয়ে দেবে, এটা কী কেউ ভেবেছিল

তিনটা প্রাণ আর কোনদিন এক হবে না
এক উড়ে গেছে, দুইজন
দুই দিকে মোড় নিয়েছে
ফিরবার কোন সম্ভাবনা নেই
ফিরে আর কী হবে, জীবন থেমে
গেলে জীবনকে ডেকে লাভ হয় না
ডাকাডাকির প্রয়োজন ফুরিয়েছে
পুনরায় গতিশীল হবে না

সামান্য ঝগড়া
এমন অসামান্য বিপর্যয় নিয়ে আসবে
কেউ ভাবে নি, ভাবনা চিন্তা করে
বিপর্যয় আসে না, বিপদ আসে না
মৃত্যুও আসে না, এ মৃত্যুও
হঠাৎ এসেছে, পরিকল্পনা ছাড়া,
এ মৃত্যুতে কারো তেমন দায় নেই

সত্যি কী নেই, দায়মুক্তি কী মিলে
গেছে, না মিলে নি, কোনদিন মিলবে না

দুটি প্রাণ যতদিন শ্বাস নেবে, বিষাক্ত নেবে
পর্যাপ্ত অক্সিজেন সত্বেও
দুটি প্রাণের নিঃশ্বাস তড়পাবে
দুটি প্রাণ আর কোনদিন সজীবতা পাবেনা

মুক্তি হবে না, মুক্তি মিলবে না
আজন্ম সাজা ভোগ করতে করতে
চির ঘুমে যেতে হবে
এ সাজা ভয়াবহ সাজা
এ সাজার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়

পুলিশের লকআপে এই প্রথম
পূর্বের কোন অভিজ্ঞতা নেই
লকআপে হিটার আছে
তবু তীব্র শীতের মত কাঁপছি
আমার জন্য যে বসার জায়গা, বেশ আরামদায়ক
তবু বসতে পারছি না, দাঁড়িয়ে থাকতেও
ভালো লাগছে না, অস্থির সময় যাচ্ছে
আর কি কোনদিন স্থির হতে পারব

আমাকে এখনো প্রশ্ন করা শুরু করেনি
হয়তো তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে
হয়তো আরও তথ্য জোগাড় করছে
এখানে অতিরিক্ত তথ্যের কিছু নেই
সবকিছু ফকফকে স্বচ্ছ
লুকানোর কিছু নেই
সবকিছু স্বীকারে আমি প্রস্তুত
অস্বীকারের কিছু কি এখানে আছে
স্বীকার অস্বীকারের এখন আর
কিছুই হবে না, বদলাবে না কিছুই

এদেশে ফাঁসির সাজা নেই
যত দুর্ধর্ষ অপরাধী হোক না কেন
মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হবে না
আজীবন সাজা মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও ভয়াবহ
আমি মৃত্যু চাইলেও তারা দিতে পারবে না

আমি চাই এই অবস্থার অন্ত হোক
আমি চাই চূড়ান্ত সাজা, ফাঁসি, মৃত্যু
আমাকে গাড়ির নিচে ফেলে পিষে ফেলা হোক
আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হোক
বিশ তলা বিল্ডিং থেকে নিচে ছুড়ে ফেলা হোক
আমাকে পানিতে চুবিয়ে মারা হোক

আমি জানি এসবের কিছুই হবে না
আমি জানি এর চেয়েও ভয়াবহ সাজা
আমাকে ভোগ করতে হবে

আমার স্ত্রীকে তারা আনেনি
সে এখন কোথায় আছে জানিনা
হয়তো তার আত্মীয়স্বজন তাকে ঘিরে রেখেছে
অথবা সে অচেতন অবস্থায়
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে

আমি কিন্তু চেতন হারাইনি
কিংবা হারিয়েছে বুঝতে পারছিনা
বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে
কোন কথা মুখ থেকে বেরোচ্ছে না
চেষ্টা করেও কিছুই বলতে পারছি না

আমার মাথা স্থির না অস্থির
আমি শান্ত না অশান্ত, চেতনে না অচেতন
এই মুহূর্তে আমি কেমন নিজেও জানিনা

তবু সুস্থির সময়ের চিন্তায়
একটু ফিরে যেতে চাই
ফিরে যেতে চাই সকালের নাস্তার টেবিলে
একটা বিয়ের কার্ড, দাওয়াত
স্ত্রীর খালাতো বোনের বিয়ে
আপন খালা নয় মায়ের চাচাতো বোন

বিয়ের কার্ড মাঝেমধ্যে আসে
সম্ভব হলে উপস্থিত হই
বেশিরভাগ সময় আমাদের ছাড়াই
বিয়ে চূড়ান্ত পরিণতিতে গড়ায়
অর্থাৎ আমাদের উপস্থিতে
বিয়ের কোনো হেরফের হয় না

আমরা উপস্থিত না হলেও
বর কনে কবুল বলবে, অতিথিরা
ভোজনে মাতবে, চারশো অতিথি
দশ সহস্রাধিক সেলফি উঠাবে
আমাদের অনুপস্থিতিতে কোন বিয়ে
আটকে গেছে বলে শোনা যায়নি

এ বিয়েতে না গেলেও চলে, তিনশো মাইলের দূরত্ব
দূরত্বের কথা চিন্তা করে একটু নারাজি জানালাম
দূরত্ব ছাড়াও আরও একটা কারণ আছে
এ পরিবারকে আমি কিছুটা অপছন্দ করি
অপছন্দের কারণ তাদের দেখানোপনা অর্থাৎ
তারা যা নয় তারও বেশি সেজে নিজেদের হাজির
করা, অতিরিক্ত সবকিছু আমার অপছন্দ
কথার পিছনে যদি কোন বস্তুই না থাকে
কথাগুলি যদি ঠাটবাটে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য হয়
তাহলে এসব কথা পছন্দ না হওয়া সমুচিত মনে করি

আমার এসব মনে করা স্ত্রীর পছন্দ নয়
তার ধারণা আমি ইচ্ছে করে তার আত্মীয়-স্বজনকে
অবহেলা করি, তাদের সমকক্ষ হতে পারিনি বলে
তাদের ঈর্ষা করি, আমি আসলে খুব ছোট মনের মানুষ

স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ায় নীরবতা পালনই শ্রেয়
বেশিরভাগ সময় তাই করি
কোন কোন ঝগড়া মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে
আমি কিছু সময়ের জন্য বিরতি নেই
অথাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যাই
ফিরলে দেখা যায় ঝড় থেমে গেছে

এ ঝগড়ায় তাই করলে হতো বিরতি অথবা নীরবতা
কিন্তু তার কিছুই আজ করিনি
স্ত্রীর সাথে সমানতালে ঝগড়া করে গেছি
ছোট ছোট বাক্য যখন তীরের আঘাত
দেয়া শুরু করে তখন পাল্টা আঘাত
করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই
ছোট ছোট বাক্য জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে
যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখাতে
দুজনেই একের পর এক যুক্তি ঝেড়ে যাচ্ছি
নিজেদের দুর্বল স্থানগুলো প্রকাশিত হচ্ছে
একজনের জন্য অন্যের জীবন পুরোপুরি
নষ্ট হয়ে গেছে তা উল্লেখ করতেও ছাড়ছি না

আঘাত পাল্টা আঘাত চলছে
কেহ নাহি ছাড়ে সমানে সমান
ঝগড়া মাত্রা ছাড়াচ্ছে, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ রাখা
কষ্টসাধ্য হচ্ছে, বিস্ফোরণ হলো বলে
আমি রাগের মাথায় চায়ের কাপ
মেঝেতে ছুড়ে মেরেছি
স্ত্রী ও কম যায় না, ভাঙ্গা ভাঙ্গিতে সমান পারদর্শী
বুঝাতে সেও চায়ের কাপ ছুড়ে মেরেছে

এবং তার মোক্ষম তীর নিয়ে
ময়দানে হাজির হয়েছে, একটা হেস্তনেস্ত করে
বাড়ি ফিরবে, আজ কোন পরাজয় নয়
যে কোনভাবেই বিজয়ী হতে হবে

প্রত্যেক যুদ্ধে আমাকেই পিছু হটতে হয়
রণে ভঙ্গ দিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়
কিন্তু আর কত, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে
ঘুরে দাঁড়ানো লাগে, এ যুদ্ধে জিততে হবে

“তুমি কমজাত কুকুরের জন্য আমার জীবন নষ্ট
তোমার জন্য আত্মীয় স্বজনের কাছে
মুখ দেখাতে পারি না, তোমার ছোটলোকি স্বভাবে
সমাজে মাথা কাটা যায়, আমার বাবা
উন্মাদ নাহলে তোমার মত ইতরের সাথে
আমার বিয়ে দেয়, তোমার মতো কুকুরের
সাথে সংসার করার চেয়ে
গলায় দড়ি দিয়ে মরা ভালো”

“আমি কুকুর, কমজাত, ইতর
তাহলে দেখো ইতরামি কাকে বলে
গলায় দড়ি কিভাবে দিতে হয়
আসো দেখিয়ে দেই”

বলে প্রচণ্ড ক্রোধে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যাই
হঠাৎ মাঝখানে এসে দাঁড়ায় আমাদের একমাত্র মেয়ে
মেয়ে আমাদের দুজনের সাঁকো
তাকে উপলক্ষ করেই আমরা বাঁচি
আমাদের কুরুক্ষেত্রে সবকিছু বিনাশ হলেও
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় শুরু করি
রাজকন্যা আছে বলেই আমাদের রাজ্য আছে
যে কোন কিছুর বিনিময় রাজ্য ধরে রাখবোই

গত কিছুদিন ধরে স্বামী-স্ত্রী একটা স্বপ্ন দেখছি
মেয়েকে গ্রামার স্কুলে পড়াবো, নয় বছরের মেয়ে
পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালো, প্রাইমারি স্কুলে
আর মাত্র দু’বছর, মাধ্যমিকে যাতে ভালো স্কুল পায়
সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি, গ্রামারের চান্স পেলে
জীবন বদলে যাবে, আমরা মেয়ের জন্য
বদলানো জীবনের স্বপ্ন দেখি, একজন প্রাইভেট টিউটর
ঠিক করা হয়েছে সামনের সপ্তাহ থেকে
প্রতি সপ্তাহ দুঘন্টা করে পড়াবে, পড়ালেখায়
ভালো মেয়ে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণে
বিচ্যুত তো হবে না বলেই এখন থেকে
কোমর বেঁধে লেগেছে, গ্রামার স্কুলে সে পড়বেই

আমাদের ঝগড়ায় মেয়ে অনুপস্থিত থাকে
আমরা চেষ্টা করি, মেয়ের সামনে ঝগড়া এড়িয়ে যেতে
আজ সম্ভব হলো না, মেয়ের স্কুল বন্ধ
উপরে হোমওয়ার্ক নিয়ে ব্যস্ত ছিল
মা-বাবার ঝগড়া শুনে নিচে নেমে এসেছে

আমি জানি পুরুষের পরাজয়
যুক্তি, তর্ক, চিৎকারে পরাস্ত হয়ে
যখন শারীরিক নির্যাতনের পথ বেছে
তখন পুরুষ পরাজিত হয়
কোন সভ্য পুরুষ নারীর গায়ে হাত তুলে না
নারীকে আঘাত করার চেয়ে অসভ্য, আমানবিক
আর কিছু হতে পারে না
নারী নির্যাতনকারী অভব্য মানুষ
পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট

সবই আমার জানা, কিন্তু
যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে সভ্যতা, ভব্যতার
চিন্তা করে না কেউ, তখন যুদ্ধ জয়ই মুখ্য
যে ভাবে হোক জয়ী হতে হবে

মা-বাবার মাঝখানে মেয়ে এসে দাঁড়ায়
মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই
পা পিছলে যায়, কাপের ভাঙ্গা কাঁচ
আর চা গড়িয়ে যাওয়ায় মেঝে পিচ্ছল
টাল সামলাতে না পেরে মাথা টেবিলের সাথে ধাক্কা খায়

তাৎক্ষণিক ঝগড়া থামিয়ে কোনো সুরাহা হয় না
রক্তে মেঝে লাল হয়ে গেছে
সতের মিনিটের দীর্ঘ অপেক্ষার পর এম্বুলেন্স আসে
হাসপাতালে পৌঁছানোর পূর্বেই
আমাদের রাজ্য উজার হয়ে যায়
মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ

রাজ্য উজারের পূর্বেই
ঝগড়া থামিয়েছিলাম কিন্তু
রাজকন্যা পছন্দ করে নি
অভিমানী হয়ে সে দেশান্তরে গেছে

আমরা বেঁচে আছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত
হয়তো বেঁচে থাকব
কন্যা হত্যার অভিশাপ নিয়ে
আমাদের বেঁচে থাকতে হবে

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৯-২০২০ | ১১:২৬ |

    পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝরঝরে শব্দানুভূতির নির্মল কবিতায় শুভেচ্ছা কবি আবু মকসুদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. আলমগীর সরকার লিটন : ১৯-০৯-২০২০ | ১২:৪৯ |

    পড়তে পড়তে হাপসে গেলো কবি দা

    GD Star Rating
    loading...
  3. ফয়জুল মহী : ১৯-০৯-২০২০ | ১৫:২৬ |

     সুশোভিত  কথামালা । 

    GD Star Rating
    loading...