তামান্না

দরজায় টক টক শব্দ শুনে তামান্না পড়ার টেবিল থেকে উঠে দরজা খোলে।
ও তুমি ?
হ্যাঁ আমি !! কেন,আমি আসতে পারি না?
আরে, তুমি ছাড়া এই শহরে আমার আর কে আছে। তামান্না কমলা রং এর ওড়না দিয়ে চোখ মুছে কয়েক বার ফোটা ফোটা জল লাবন্যময় মুখটাকে মলিন করে দেয়। কাল আমার পরীক্ষা তাই আমি মনে করছি মা আসবে দেখতে।
ও আচ্ছা, মার কথা মনে পড়ছে। তোমাকে ফোন করে নাই? আসতে না পারলেও একবার ফোনতো করতে পারে মা।
মা, –মাগো।
এই তোমাকে কোন দিন কাঁদতে তো দেখি নাই, আজ কি হল। মন খারাপ হলে পরীক্ষা ভাল হবে না আমার কথা শুনো, এই আমার কথা শুনো। সকালে তুমি পরীক্ষা কেন্দ্রে চলে যাবে তাই এখন দেখা করে যেতে আসলাম। ভাল করে পরীক্ষা দিবা তোমার পায়ের নিচে শক্ত মাটি দরকার।
তুমি দোয়া করো।
হা হা হা (হাসি) দোয়া দিয়া পাশ করা যায়? ভর্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশী নাম্বার ফেলেও ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া যায় না যদি সে মাদ্রাসার ছাত্র হয়। হয়তো এদেশে দোয়া দিয়েই ছাত্র-ছাত্রী পার হবে একদিন। বরুড়ার চিকন সরু আকা বাঁকা রাস্তা আজ শুধু স্মৃতি। কুমিল্লা শহর টাকে মনে হয় আমার পৃথিবী এই শহরে সৌরভের বাস বলে হয়তো এত ভাল লাগে। কিন্তু কিছু কিছু লোক দেখলে কেন এত ভয় লাগে জানি না। ঘৃণায় কেন বমি বমি ভাব লাগে তা বুঝতে পারি না। সৌরভ শিক্ষিত বেকার গরীব এক ছেলে অথচ তার উপর সব ভরসা আমার। তাকে আপনজন থেকেও আপন লাগে।

(২য় খণ্ড)
তোর মত ছোট লোকের ঘরে আর থাকবো না তুই একটা হারামীর বাচ্চা।
ওই ওই, আমার মা বাপকে গালি দিলে ভাল হবে না তোর কপালে এই ঘরের ভাত উঠে যাবে।
আমিও আর থাকতে চাই না।
বউ-জামাইর ঝগড়া ফেল ফেল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে দেড় বছরের তামান্না কি নিয়ে ঝগড়া বুঝতে চায় হয়তো। মেয়েটা ঝটকা মেরে কোলে তুলে জামাইর ঘর ছাড়ে রুপালী। মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি আসে, আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর। পাশের গ্রামের পরের গ্রামে রুপালীর বিয়ে হয় আব্বাস মিয়ার সাথে। রুপালী টকবগ যুবতী হয়ে উঠতে চোখ পড়ে আব্বাসের সাত ক্লাস পার হয়ে আর আট ক্লাস পড়া হয় না। রুপালীর বাপ-ভাইর কাছে আব্বাস বিয়ের জন্য প্রস্তাব পাঠায়। তারা তাতে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়, অনেক ধনবান শুনে খোঁজ খবর ছাড়া এক সপ্তাহের ভিতর বিয়ে দিয়ে দেয় রুপালীকে। বাসর রাতটা হয়তো সুখের ছিল।
না ভাবী সেই রাতও ছিল সাদা সুখের, প্রতি রাতে সে মদ খেয়ে বাড়ী ফিরত। আমি প্রথম প্রথম চুপ করে সহ্য করতাম আর যখনি তার খারাপ কাজের প্রতিবাদ শুরু করলাম, তখনি নেমে আসলো প্রচন্ড অত্যাচার। দেখো দেখো আমার শরীলটা মেরে আমাকে বেহুঁশ করে ফেলত। তোমাকে দেখাতে পারছি না আমি শরীরের সব অংঙ্গ সিগারেটের আগুন চেপে ধরত আমার গায়ে। এখন আবার তোমরা সবাই বলছো তার কাছে ফিরে যেতে।
মেয়ে মানুষ ফসলি জমিনের মত মন, শরীরের উপর অন্য লোক ফসল ফেলায়। যা মা যা, জামাই নিতে আসছে যা। স্বামীর পায়ের তলায় স্ত্রীর জান্নাত। তার পায়ের তলায় জাহান্নামও নাই মা । আমি আর তার সংসারে যাব না তার মেয়েটাকেও নিয়ে যেতে বলো। আমি তার মেয়েও রাখতে চাই না।

(৩য় খণ্ড)
আপা মেয়েটা কে? ঠিক যেন আপনার চেহারা। দোকানদারের এমন প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে রুপালী তামান্নার দিকে চেয়ে থাকে। চিকন একটা হাসি দিয়ে বলে আমার বোনের মেয়ে দোকানদারের সাথে মায়ের মিথ্যা পরিচয় দেওয়া যেন আত্মহত্যার মত লাগে।
জলদি জলদি এই দুইটা কাপড় প্যাকেট করে দিন আমি আবার কুমিল্লা ফিরে যেতে হবে। নিজের কামাই করা টাকায় মাকে শাড়ী কিনে দিতে গিয়ে পরিচয়হীন হয়ে যাওয়া, বাহ্ দুনিয়া!! আমার ভিতর যে দুইটি কিডনি একটি মায়ের আরেকটি বাবার মনে হয়। জানো সৌরভ মন চায় দুইটা কিডনিই শরীর থেকে চিড়ে ফেলে দিতে যে দিন মার বিয়ে হয় সে দিন খুব কেঁদে ছিলাম। ওই দিন থেকে শুরু ছোট দুই নদীর পানিতে প্লাবন, যে প্লাবনে আমার বুক প্লাবিত হত এখনো হয়। আমার সামনে মা বিয়ের শাড়ী পরে অন্য লোকের বউ হয়ে চলে গেলেন ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারতাম না,বলতে পারতাম না। কিন্তু বুকটা আমর তখন থেকে পাথর হয়ে গেছে যখনি মার কথা মনে পড়তো, ছুটে যেতাম তাঁর রুমটাতে, দাঁড়িয়ে থাকতাম নীরব হয়ে। তখন আমার বয়স হয়তো ৮-১০ হবে নানী যেন আমার মা হয়ে গেল।

রাতে নানীর বুকে স্বর্গ খোঁজতাম বড় হওয়ার সাথে সাথে মামনি ঘরের কাজ করতে দেওয়া শুরু করলো। কাজ না করলে মারতো, এখন যেমন বাংলা লাটসাহেবের বউরা চাকরানীদের মেরে নিউজ হেড়লাইন হয়। মা যখন নতুন বাবা কে নিয়ে তাঁর মায়ের বাড়ী বেড়াতে আসতো, তখন নানী আমাকে পাঠিয়ে দিত আমার কোন আত্নীয়ের বাড়ী, দেখা হতো না মায়ের সাথে। মায়ের দেখা পেতে, মায়ের একটু পরশ পেতে আজও আমি কেঁদে চলি। সব প্রতিকূলতায়ও কেমন জানি আমার লেখা-পড়া করতে মন চাইতো। নানী তাই মামনির চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করায়,কাজ আর ভুল ভ্রান্তির নির্মম কষাঘাত এর ভিতরে আমার জীবন আটকে গেল। তারপরও পড়া-লিখা করলাম আমি।

(৪র্থ খণ্ড)
মেয়ে মানুষের রূপ কি আসলে থাকা দরকার?বলো সৌরভ। এই শরীরের রূপ দেখে তো আমার বাবা মা রুপালীকে বিয়ে করে ছিল। আর মার রূপের বিনিময় আজ আমি! মায়ের রূপের কারণেই আজ আমি মা হারানো। এই রূপের কারণে আজ আমি দেহ শ্রমিক। ওহ! চুপ করো।
না, আজ আমাকে বলতে দাও সৌরভ, এই রূপের কারণেই আমি মামা শালা দ্বারা ইজ্জত হারা। আর এই কথা আমি প্রকাশই করতে পারি নাই। মামনির শত অত্যাচারও সয়ে গিয়েছি কারণ থাকা-খাওয়া, পড়া-লিখার সুযোগ ছিল বলে। যে লোকটা আমাকে জন্ম দিলো আজ পর্যন্ত কোন দিন খোঁজও নিলো না। অথচ তাদের অপেক্ষায় আমার যায় দিন, আমি অপেক্ষা করি কাশ্মীরি সন্তানদের মত। আমি অপেক্ষা করি বাংলাদেশের গুম হওয়া লোকজনের স্বজনদের মত, আমি জানি আমার মা-বাপ জীবিত, তারপরও হবে না দেখা কোন দিন. শুন, আমি এই সব শুনতে চাই না, আমি তোমার অতীত বর্তমান সব কিছু নিয়ে। তোমাকে ভালবাসি বলে তোমার জন্য এই বন্ধুর পথ চলা সৌরভ। মেট্রিক পরীক্ষার পর মামনি বেড়াতে নিয়ে গেল তার বাবার বাড়ী। আমিও গেলাম হাসি-খুশি আমি তো জানতাম না ওইখানে অপেক্ষা করছে সর্পের ছোবল। মামনির ছোট ভাই আমার ইজ্জত লুুটে নেয় নানীকে বললাম সব কিছু, মামা শুনে বলে মিথ্যা কথা। বাড়াবাড়ী করলে নানী নাতনী দুইজনকে ঘর ছাড়তে হবে। এইটাই যেন মামি চায় তাই সে শুকনিমামার হাসি দেয়। কোন এক গ্রীষ্মের বাদলা দিনে আমি নানীর ঘর চাড়া হই। যে লোকটা আমাকে নিয়ে আসলো, সব কিছু বলেই নিয়ে আসলো। দেহ বিক্রির বিনিময় আমি শুধু ভাত চাই, একটু নিরাপদ রাত যাপন করার জায়গা চাই। কুমিল্লা শহরের গলি গলি দৌড়িয়েছি আমি, মানুষের একটু দয়াময় করুণার জন্য। কত মানুষ যে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ছিল, তাদের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আমি হয়ে যাই ধর্মহীন পতিতা, আর সেই সব লোক পবিত্র ও ভদ্র। তারপর ও বাঁচতে মন চায় শিক্ষিত হতে মন চায়, মা হতে মন চায়। চলার পথেতো তোমাকে পেলাম তোমাকে পেয়ে যেন বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করলাম। তুমি আমাকে ভালবাসো অনেক, তা আমি জানি আর আমি,পড়া-লিখা আর বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে ছুটে চলি মানুষের বিছানায়।

তামান্না, আমি একটা চাকুরী ফেলেই বিয়ে করে ফেলবো তুমিই হবে আমার রাণী ভুলে যাব সব অতীত। চলে যাব কোন এক নতুন ঠিকানায়।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৮-০৯-২০২০ | ১০:২৪ |

    অণুগল্পটি পড়লাম মি. ফয়জুল মহী। আমাদের সামাজিক জীবনের সেই চির চেনা যে দিকটি রয়েছে সেটাই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

    পড়তে গিয়ে যেন পরিচিত কারু ফ্লাশব্যাকে চলে গিয়েছিলাম। বেশ লিখেছেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ফয়জুল মহী : ১৮-০৯-২০২০ | ১৪:১৮ |

      এই সমাজ এই জীবন বাংলার 
       কেউ সুখী কেউ জনম দুঃখী। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. নিতাই বাবু : ১৮-০৯-২০২০ | ১২:৫৮ |

    অণুগল্পের ৪ অংশ পড়ে ভাবনায় ডুবে গেলাম। কিছু সমাজের শুভ অশুভ চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠেছ।  শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।          

    GD Star Rating
    loading...
    • ফয়জুল মহী : ১৮-০৯-২০২০ | ১৪:৩০ |

      ভদ্র বলে দেখে না রাস্তার অভদ্র পরিচয়হীন বাচ্চাকে , কিন্তু রাতের আধারে ঠিকই দেখে বস্তির জোছনাকে । 

      GD Star Rating
      loading...