পদ্মার বুকে এভাবেই দাড়িয়ে রই আমি: হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।
আমি হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তোমাদের এই দেশের সর্ববৃহৎ রেল সেতু। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে আমি কতবড়? বলছি দাঁড়াও, আমি ১৭৯২.৮ মিটার ( প্রায় ১.৮কিমি) দীর্ঘ। এটা ভেবে মাঝে মধ্যে গর্ববোধ করি যে আমি তোমাদের দেশের সবচেয়ে বড় রেলসেতু। আমার আরও একটি গর্বের জায়গা কি জানো? আমি একটা শতবর্ষী ব্রিজ, ক’ বছর আগেই ১০০ বছরে পা দিলাম। আমার জন্ম কত সালে জানো, সেই তোমাদের দাদাদের জন্মের সময়ে। সেই ১৯১০ সালে! …আমি বাপু সেই ব্রিটিশ আমলের ব্রিজ। আমার নাম হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কি করে হলো জানো কি? তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর নামে। ভাইসরয় কি তা আবার আমায় জিজ্ঞেস করো না। কারন আমি লোহার ব্রিজ, তোমাদের মত পণ্ডিত নই, অতকিছু আমি জানিনা। আমাকে বানানোর কারণ আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর বঙ্গের সাথে কলকাতার যোগাযোগ সহজ করার জন্য, কারণ মাঝখানে ছিলো পদ্মা। আমি সেই পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে তোমাদের যোগাযোগ সহজ করে দিচ্ছি।
আমাকে বানাতে কত শ্রমিক লেগেছিল জানো? ২৪,০০০ শ্রমিকের ৫ বছর। তাহলেই বোঝো, আমি কত বড়! কখনো কি ভেবে দেখেছো? প্রবল পদ্মার স্রোতেও আমি একশ বছর দাঁড়িয়ে আছি! যেখানে একবার নদীর পানি বাড়লেই তোমাদের বাড়িঘর ভেঙে তছনছ হয়ে যায়, সেই পদ্মার বুকেই আমি একশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এখনও আমার কিছুই হয়নি… ও হ্যাঁ আমি একবার ভেঙে পড়েছিলাম তোমাদের স্বাধীনতার সময়ে.. আমাকে প্লেন থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। বোমার আঘাত সহ্য করতে পারিনি; তখন একবার ভেঙে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি আমি শেষ আমি আর কোনদিন দাঁড়াতে পারবো না তবে তোমার আমাকে মেরামত করে দিয়েছো… এ কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার নেই। কারণ আমি তো ইস্পাতের তৈরী ব্রিজ। আমি শত বছর ধরে দেখে যাচ্ছি তোমাদের এই দেশটাকে… তার আগে বলি একটা হাসির গল্প: গ্রামের নিরক্ষর একদল মানুষ আমাকে দেখতে এসেছে। একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করছে “ওটা কিসের? ” “লোহার? ” ওরে!! নয় মন নোয়াই( লোহাই) লাগছে!” ওদের কথা শুনে একগাল হেসেছিলাম। তোমরা এটাও ভাবো আমার ওজন কত? আচ্ছা আর কি ভাবো আমায় নিয়ে ? লালন শাহ সেতুর ( হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পাশের সড়ক সেতু) উপর দিয়ে গাড়িতে করে যাও, তখন আমার পানে একদৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকো! কিন্তু কি ভাবো আমায় নিয়ে? জানতে ইচ্ছে হয় খুব জানতে ইচ্ছে হয়!
আমি যদি তোমাদের মত কথা বলতে পারতাম তবে বলতামঃ দাঁড়াও হে পথিক, দুটো কথা বলি তোমার সাথে.. কিন্তু আমি তো আর তোমাদের মত মানুষ নই। কথা কইতে পারি না। জানো পদ্মার বুকে মাঝে মধ্যেই দেখি আমার নিচ দিয়ে লাশ ভেসে যাচ্ছে.. আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাকে একবার পদ্মা থেকে তুলে জড়িয়ে ধরতাম। কেউ নেই সেই লাশের। কোন খোঁজও থাকে না, এটা ভাবতে ভাবতে লাশটা পদ্মায় ভাসতে ভাসতে চলে যায়। জানো যেদিন অমনটা দেখি সেদিনটা খুব কষ্ট পাই। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কি করে কাঁদবো? আমি যে তোমাদের মত মানুষ নই। পরক্ষণেই ভাবি আমি মানুষ নই ভালোই হয়েছে, আমি তো আর কাউকে মেরে পানিতে ভাসিয়ে দেই না.. সেদিক থেকে বোধ হয় তোমাদের থেকে আমিই ভালো।
আমি কথা বলতে পারিনা বোবা, বোবার তো শত্রু নেই। তাই আমারও শত্রু নেই। আমি তোমাদের ব্রিটিশ আমল দেখেছি, পাকিস্তান দেখেছি, তোমাদের বাংলাদেশ ও দেখছি। বলার আছে অনেক কিন্তু কি করে বলবো? আমি তো বোবা। আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু তোমরা আর শোনো কই? তাই আর বললাম না। একটা কথা কি জানো? আমি বাঁচতে চাই আরও সহস্র বছর। কথা বলতে না পারি তোমাদের তো উপকারে আসতে পেরেছি। না হয় তোমাদের জন্যই আমি আমার জীবনটাকেই উৎসর্গ করে দিলাম….
.
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
loading...
loading...
গতানুগতিক পোস্টের বাইরে অসাধারণ একটি উপস্থাপনা পড়লাম। সাথে ইতিহাস। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং স্বাগতম এই শব্দনীড়ে। গুডলাক।
loading...
পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ। পাশে থাকবেন
loading...
অজানাই ছিলো। খুব ভালো একটি পোস্ট পড়লাম ভাই। শুভেচ্ছা সহ ভালোবাসা।
loading...
অসংখ্য ধন্যবাদ…. সাথে থাকবেন
loading...
সাহিত্যরস সিক্ত তথ্যবহুল সুন্দর লেখা। শুভেচ্ছা।
loading...
আপনাদের উৎসাহে সাহস পাই….. পাশে থাকবেন….
loading...