একজন রিকশাওয়ালা

আজ কদিন ধরে বেশ ঠান্ডা লেগেছে। মৌসুমের এই সময়টা আমার ঠান্ডা জ্বর প্রবল রুপে দেখা দেয়। ভোরের আযানের সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রাতঃকৃত সেরে ওযু করতেই হাঁচি শুরু হয়ে গেলো। মারাত্মক অবস্থা,সেই সাথে নাক দিয়ে ঝরছে কাঁচা পানি। মধ্যে এই ঠান্ডার জ্বালাতন বেশ দমন ছিলো, ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন নাকে নাকি মাংস বেড়েছে, পলিপাস না কি একটা রোগ।

আমি দরিদ্র মানুষ সারা বছরই খেটে খাই। দিন আনি দিন খাওয়া যাকে বলে। থাকি বস্তির ঝুপড়ি ঘরে।পাঁচজনের সংসার এই বাজারে এক জনের আয়ে চালানো খুবই মুশকিল। সেই জন্য জামিলাবিবি স্বেচ্ছায় দুটো বাসা বাড়ির কাজ নিয়েছে। বাসা দুটো ভালো । মাসিক বেতন সহ রোজা সহ দুই ইদে প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। জামিলা খুব ভালো মেয়ে।
মেয়ে বলা ভুল এখন সে বউ মানুষ। আমার মিষ্টি বউ। মাঝে মাঝে আমাদের রোমান্টিক সময়ে তাকে মিষ্টিরাণি বলেও ডাকি।
এত অভাব তবু তার কোন অভিযোগ নেই। হাসিমুখে সে সব সময় সংসার সামলায়। কখনো একটু অভিযোগ জানায় না।
নিয়মিত সে খুব ভোরে উঠে বাচ্চাদের কিছু সময় পড়িয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে
নাস্তাপানি রেডি করে স্কুলে পাঠায়। আমি অবশ্য তার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই ।
সকাল সকাল না গেলে ভালো রিকশা হাতছাড়া হয়ে যায়। লক্কর ঝক্কর রিকশা টানতে জীবন শেষ হয়ে যায়, মটরের রিকশায় অবশ্য আরাম আছে। কিন্তু পৌরসভা থেকে মটরের রিকশা বেআইনি ঘোষনা করেছে।তাই জন্য ইদানিং কষ্ট বেশি করতে হচ্ছে।

বয়স হয়ে যাচ্ছে, পরিশ্রমের কাজে এখন সহজে হাফ ধরে যায়। কি আর করা এভাবেই কাটাতে হবে জীবন। তিন ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলতে হবে।
জামিলার খুব শখ ছেলে মেয়েগুলোকে লেখা পড়া শেখাবে। সে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে। অভাবের জন্য তার আর পড়াশোনা করা হয়নি। তার নিজের শখটা সে ছেলেমেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চায়। আমিও নিজের জীবন দিয়ে বুঝি পড়ালেখা ছাড়া গতি সত্যিই নাই। বাকী আল্লাহর ইচ্ছা।
মধ্যে একটা বছর সর্দি বেশ কম ছিলো। বলা যায় দমন ছিলো।আমি শুনেছি পলিপাস রোগ হোমিওপ্যাথিতে ভালো হয়। রোগ অবশ্য ভালো হয়নি কিন্তু দমন থাকলে শরীরে একটু আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু টাকার অভাবে বেশ কটা দিন আর ওষুধ খাওয়া হয়নি। এখন কি একটা অবস্থা। রোগটা আবার ফিরে এসেছে।
আজ অবশ্য বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। করোনা না কি একটা ভাইরাসের জন্য স্কুল বন্ধ। আমি ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। জামিলা বিবি ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক…….ঘুমন্ত জামিলা আর বাচ্চাদের মুখ দেখে মনটা শান্তিতে ভরে গেলো। ওদের জন্য ই তো এসব কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে আমি রিকশা গ্যারেজে এসে পৌছলাম।
রহিম মিয়া আমার হাঁচি দেখে বললেন,
-কিগো মিয়া কি বাধাইলা। এতো হাঁচি দাও কেন?
-আবার সর্দি লেগেছে। কি যে জ্বালা। এই রোগ আমার যাবেনা।
-রিকশা নিবা নাকি?
-হ্যাঁ রিকশাতো লাগবেই।
-যেই হাঁচি মারতেছো। লোকে কি তোমার রিকশায় উঠবে?
-দেন দেখি? পেট তো আর বসে থাকবে না।
-দেখো জমা কিন্তু মাফ নাই। আমিও জানি জমা মাফ নাই।
আমি রাজি হয়ে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে বের হলাম। আজ মনে হয় রাস্তা ঘাটে লোকজন কম। তবে আল্লাহর রহমতে প্রথমে একটা দুরপাল্লার যাত্রী পেয়ে গেলাম। শ’খানেক দেবে।
ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে পথ চললাম।
এর মধ্যে দু একবার হাঁচি দিতেই ভদ্রলোক বেশ কাঁচুমাচু করে তাকালেন।
আমি মাথা ঘুরিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম, ভাইজান ভয় পাবেন না আমার নাকে পলিপাস, অন্য কিছু না, তাই এই হাঁচি।
ভদ্রলোক কোন কথাই বললেন না। হয়তো আলাপ বাড়াতে রাজি নয়।
রিকশা থেকে নামার আগে বললেন তুমি একটু ডাক্তারের কাছে যাও টেষ্ট করিয়ে নাও। তোমার লক্ষণ ভালো না। এখনই তুমি বাসায় ফিরে যাও। তোমার রাস্তায় থাকা ঠিক না। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। আজ রাস্তায় অনেক কম লোক চলাচল করছে। ভাড়া তেমন নাই। তার উপর হাঁচির জন্য তিন/চারটা প্যাসেঞ্জার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। মনটা খুব খারাপ, রহিমচাচা ঠিকই বলেছেন এখনও জমার টাকাটা ঠিক মতো উঠেনি। গরীবের কেউ নাই।
গরীবের আছে শুধু দুঃখ আর কষ্ট।
আমি কিভাবে এই সন্দেহ দূর করবো তাই ভাবতে ভাবতে আবার রিকশা টানতে লাগলাম। এবার হাঁচি আসলেও চেপে গেলাম। তবুও প্যাসেঞ্জারের দেখা নাই। এই শহর তো এমন খাঁ খাঁ কোনদিনই করে না। কি এমন হলো? সত্যি কি দূর্যোগ আসছে। সবার মনটা খুব মনমরা। দুপুর রোদে শুধু বারবার চোখের সামনে জামিলাবিবি আর বাচ্চা তিনটার মুখ ভেসে উঠতে লাগলো।
আহা আমার যদি এখন কিছু হয়ে যায় তাহলে ওদের কি হবে?
মনে মনে শুধু বলতে লাগলাম. আল্লাহ তুমি রহমানের রহিম তুমি দুনিয়া থেকে এই করোনা ভাইরাস তুলে দাও। তুমি সব পারো আল্লাহ। তুমিই ভরসা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৭ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৩-২০২০ | ২০:১০ |

    চেনা জানা … আমাদের আশে পাশের নাগরিক জীবনের গল্প। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • ইসিয়াক : ২১-০৩-২০২০ | ১৯:৩২ |

      পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা সহ শুভকামনা জানবেন ভাইয়া

      GD Star Rating
      loading...
    • ইসিয়াক : ২২-০৩-২০২০ | ৭:২০ |

      ভালো আছেন নিশ্চয়।
      সবসময় আপনজন নিয়ে সাবধানে থাকুন।
      সতর্ক থাকুন

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ২২-০৩-২০২০ | ৮:০৯ |

        আমি ভালো আছি। আপনাকে ধন্যবাদ।

        GD Star Rating
        loading...
  2. ফয়জুল মহী : ২০-০৩-২০২০ | ২:২৪ |

     দারুণ লেখা 

    GD Star Rating
    loading...
    • ইসিয়াক : ২১-০৩-২০২০ | ১৯:৩১ |

      আন্তরিক মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ রইলো।

      GD Star Rating
      loading...
    • ইসিয়াক : ২২-০৩-২০২০ | ৭:২০ |

      ধন্যবাদ

      GD Star Rating
      loading...