৭৪।
ফোন রেখে রাশেদ সাহেব রুমে এসে বাইরে যাবার শীতের কাপর পরে হ্যান্ড গ্লোভস পকেটে নিয়ে নিচে এসে সেদিন কবিরের দেখিয়ে দেয়া গোপন জায়গা থেকে চাবি নিয়ে বাইরে বের হয়ে দরজায় তালা দিয়ে আবার গোপন জায়গায় চাবিটা রেখে কবিরের দেখানো পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বেশ ঠাণ্ডা, হ্যান্ড গ্লোভসটা হাতে পরে নিলেন। মাফলারটা আনা দরকার ছিলো কানে ঠাণ্ডা লাগছে।
আকাশ ভরা রোদ, বিলাতে এরকম আকাশ দেখা নাকি ভাগ্যের ব্যাপার, তবুও কি ঠাণ্ডা। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে সেদিন বাস থেকে যেখানে নেমেছি্লেন সেই জায়গা। বায়ে ঘুরে দেখে একটা দশ বারো ফুট উঁচু পিলারের মাথায় বিভিন্ন জায়গার নাম লেখা দিকনির্দেশনা। লাইবেরি লেখা বোর্ডটা যেদিকে তীর চিহ্ন দিয়ে ঘুরানো রয়েছে সেদিকে হেঁটে কিছুদূর যেতেই দেখে কবির যেভাবে বলেছে সেই রকমই ডানে সমারফিল্ড সুপারস্টোর বায়ে লাইবেরি। সমারফিল্ডে পরে যাব আগে লাইবেরিতে যাই। সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখলো অনেক পুরানা বিল্ডিং, আশে পাশে অনেক গাছপালা কিন্তু কোনটায় পাতা নেই সব পাতা শীতে ঝরে ন্যাড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢুকে পড়লো। নিচ তলায় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে প্রায় সব দরজাই বন্ধ। পাশেই উপরে যাবার কাঠের সিঁড়ি, উপরে উঠেই বাইরের শীতের চেয়ে এখানে উষ্ণতা অনুভব করলেন। এখানে হিটার চলছে। হাতের গ্লোভস খুলে জ্যাকেটের পকেটে রাখলেন। সিকিউরিটি গেট পেরিয়ে বাম পাশে রিসিপশন। সমস্ত ঘরটাই নীরব সুধু রিসিপশনের একজন তার মত অন্য একজনের সাথে ফিস ফিস করে কথা বলছে। একজন বিরাট এক কম্পিউটারে কাজ করছে আর একজনে কম্পিউটারের মনিটর দেখে কিসব গুছিয়ে রাখছে। পাশে দাঁড়াতেই একজন মহিলা যিনি গুছিয়ে রাখছিলেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো-
-আমি কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?
-আমি একটু ইন্টারনেট ব্যাবহার করবো।
-আগে বুকিং করেছ?
-না।
-কার্ড আছে?
-না।
মহিলা একটা ফরম দিয়ে পূরণ করতে বললো । একটা কলম বের করে দিলো সাথে। ফরম পূরণ করে দিতেই সেটা নিয়ে কম্পিউটারে কি কি এন্ট্রি করে জিজ্ঞেস করল-
-কতক্ষণ ব্যাবহার করবে?
-কতক্ষণ করা যায়?
-একদিনে এক ঘণ্টা, এর বেশী করতে হলে ঘণ্টা প্রতি এক পাউন্ড।
-ঠিক আছে তাহলে এক ঘণ্টা।
-আচ্ছা ওই যে তিন নম্বর কম্পিউটার আর এই হলো তোমার পিন নম্বর।
একটা ছোট্ট কাগজ এগিয়ে দিলো। কাগজটা নিয়ে ওখান থেকে সরে এলো। এতক্ষণে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বেশ বড় হল রুম, অনেক পুরাতন অনেক কিছু আছে। দেখবো সব কিছু ঘুরে দেখবো আগে মেইলটা পাঠিয়ে নেই। বাড়িতে সবাই ভাবছে। টেবিলে বসে পিন নম্বর দিয়ে লগ ইন করেই সরাসরি ইয়াহু পেজ পেয়ে সাইন অন করে মেইল লিখতে শুরু করলেন।
মনির দেশে ফিরে যাবার সময় পথের বিবরণ শুনে তার মনের অবস্থা কি সেসব লিখে সেদিন হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব কিছু প্রায় দুই পাতা ভরে সংক্ষেপে লিখলো। ঘড়িতে দেখে মাত্র দশ মিনিট বাকি রয়েছে। এবার রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা লিখেই শেষ করলো। মেইল পাঠিয়ে দিয়ে রিসিপসনে এসে জানালো আমার শেষ কিন্তু আমি কি লাইবেরিতে অন্য কিছু দেখতে পারি?
ধন্যবাদ জানিয়ে বললোক-
-হ্যাঁ তুমি ইচ্ছা করলে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত থাকতে পারো কোন নিষেধ নেই।
দৈনিক সংবাদপত্র, কয়েকটা সাময়িকী এবং এই শহরের পত্তন কাহিনী সহ বর্তমান বিবরণ, শহরের ম্যাপ, বাসের শিডিউল এই শহরে কোথায় কি ঘটছে ঘটবে এধরনের যাবতীয় তথ্য, বিভিন্ন রকমের বই, কয়েকটা হাই স্পিড ব্রডব্যান্ড লাইন সংযুক্ত কম্পিউটার ইত্যাদি নানান কিছুতে ভরা এই লাইবেরি। এদেশের ছোট বড় সব শহরেই নাকি এই রকম একটা লাইবেরি থাকে। কার কোথায় কি প্রয়োজন জানো না, যাও লাইবেরি থেকে জেনে আস। কে কোন কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাও সেখানে কি আছে কি নেই জানো না, জানতে চাও তবে যাও লাইবেরি থেকে জেনে আস। বর্তমান প্রজন্মকে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে যা প্রয়োজন তার সবই পাবে এখানে। শুধু বর্তমান প্রজন্ম নয় আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই এখানে আসতে পারে। কোথাও কোথাও লাইবেরিই তাদের মিলন কেন্দ্র। দিনের বেলা লাইবেরি আর রাতে পাব এদের সামাজিক মিলন কেন্দ্র।
হায়রে অর্থ! হায়রে পাউন্ড! তুমি এদেশের জন্যে কি করেছ আর আমাদের দেশের জন্যে কি করছ? এরকম একটা লাইবেরির সুযোগ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা পেলে কোথায় এগিয়ে যেতো! এদেশে এখনকার প্রজন্ম তাদের পূর্ব পুরুষদের কৃত কর্মের ফল ভোগ করছে। তারা ছিলো কর্মঠ, উচ্চাভিলাষী, সুদূর প্রসারী দৃষ্টি সম্পন্ন। ওরা সারা বিশ্ব জুরে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, সারা বিশ্বের সম্পদ এনে নিজের দেশ গড়েছে। এদের বাড়িঘরের কাঠামো, চলাচলের রাস্তা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজন দেখেই বোঝা যায়। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে যেখানে বৎসরের অর্ধেকই থাকে সংকুচিত হয়ে, কোন কাজ করা যায়না তার মধ্যেও ওরা কিভাবে এসব গড়ে তুলেছে কি ধরনের পরিকল্পনা করেছে কি রকম গঠন মূলক চিন্তাভাবনা ছিলো তা না দেখলে বোঝা কঠিন। আর আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিলো আয়েশি, ভোগ বিলাসী, অলস, কোন রকম মাছে ভাতে দিন গেলেই খুশী। সাথে যদি একটু নাচ গানের আয়োজন থাকে তাহলেতো কথাই নেই, আর কিচ্ছু চাইনা।
কিন্তু আশ্চর্য হলো মাত্র কয়েকজন মানুষ এই এতো বড় লাইবেরি ব্যাবহার করছে। দুই তিন জন বুড়া বুড়ি পত্রিকা পড়ছে, একজন কম্পিউটারে রয়েছে আর একজন মধ্যবয়সী মহিলা বই পড়ছে। এখানে ইংলিশ শেখার জন্যে অডিও ক্যাসেট, ভিডিও ক্যাসেট, বই, গানের সিডি এবং সিনেমার ডিভিডি নানান কিছু রয়েছে যা নাম মাত্র ভাড়া দিয়ে দুই সপ্তাহের জন্যে বাসায় নেয়া যায়। যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ তারাও শিখছে আবার যাদের মাতৃভাষা ইংলিশ নয় তারাও শিখছে। এই লাইবেরি দেখে মনে হয় সত্যিই জ্ঞানের ভাণ্ডার। জ্ঞানের বিশাল ভাণ্ডার এখানে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জ্ঞানের মশাল জ্বেলে তার এলাকা আলোকিত করে রেখেছে অনেক দিন ধরে। তার এলাকার নাগরিকদেরকে মানুষ করে গড়ে তোলার জন্যে, সুপথে চলতে শেখানোর জন্য। এগুলি আর একদিনে হয়নি। রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে দেখেন আর ভাবেন এ কোথায় এলাম! এখানে না এলে এসবের কিছুই জানতে পারতাম না কিছুই দেখতে পেতাম না! আমার দেশের সাথে তুলনা করতে পারতাম না। টাকা আর পাউন্ডের তফাত কি তা জানতে পারতাম না। গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু আর এই লাইবেরির তফাতটা কোথায় কিছুক্ষণ ভাবলেন। না এক দিনে এই লাইবেরি দেখা সম্ভব না পরের অফ ডেতে আবার আসব। একটু আফসোস করলেন একটু পরে যদি মেইলটা পাঠাতাম তাহলেতো এ সম্পর্কে কিছু লেখা যেতো! পরের বার যখন আসব তখন লিখবো মনে মনে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলেন।
loading...
loading...
এই সুপরিসর উপন্যাসের সাথে আমরা যেন হেঁটে চলেছি আপনার দেশ দেশান্তরে!
শুভকামনা প্রিয় খালিদ ভাই।
loading...
আস্তে আস্তে হাটাই ভাল। শুভকামনা।
loading...
শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় বন্ধু।
loading...