মুরগীমায়ের হাঁসছানা

ছানাদের নিয়ে মুরগী মা এই প্রথম পুকুরপাড়ে এলো। মালিকের বাড়ির পেছন দিকে বেশ বড় একটা পুকুর। ঘাট বাঁধানো। তিনপাড় জুড়ে সারিসারি নারকেল গাছ। নির্জন ছায়াঘেরা।

গরমের দুপুরে একটু আরামে ছানাদের নিয়ে বিশ্রাম নেবে ভেবে ছানাদের বলে- আয় সোনারা, এই ছায়ায় আমার পাশে তোরা একটু শো। এই গরমে আর ঘোরাঘুরি করিসনে।

ছানারা মায়ের কাছে আসে। দু’একটি শুয়েও পড়ে। হঠাৎ একটি ছানা পুকুরের দিকে তাকায়। চোখে পড়ে টলটলে জল। আর জল দেখেই ছানাটির বুকের ভেতরে যেন জেগে ওঠে এক অদম্য উচ্ছ্বাস। মনটা যেন আইডাই করে ঝাঁপ দিতে ওই জলরাশির মধ্যে।

চিৎকার করে অন্য ছানাদের বলে- এই, দেখ, দেখ, কত জল ওই পুকুরে।

সাথে সাথে অন্য ছানারা তাকায় পুকুরের জলের দিকে। সব ছানারই মনের ভেতর অনুভূত হয় এক ভিন্নতর সুখ। মনে হয়, কতদিন ধরে তারা যেন এই প্রিয় জলের খোঁজেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এক্ষুনি তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় জলে।

অতি আবেগে সোৎসাহে একসঙ্গে সবাই মাকে বলে- মা, আমরা একটু পুকুরের জলে নামতে চাই। ডুব-সাঁতার খেলতে চাই।

মার বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁত করে ওঠে। এই ভয় তো মুরগী মা’র মনে সবসময়ই ছিল। যেদিন ডিম ফুটে প্রথম ছানাটি বেরিয়েছিল, তখন সেই ছানাটির চেহারা দেখেই বুঝেছিল- গিন্নিমা ওকে ফাঁকি দিয়ে হাঁসের ছানা ফুটিয়ে নিচ্ছে। ওর ডিমগুলো সরিয়ে রেখে সেখানে রেখেছে হাঁসের ডিম। আর সেগুলোই এতদিন ধরে তা দিয়ে এসেছে সে।

মনেমনে প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল সেদিন মুরগীটির। দুঃখে ক্ষোভে বাকি ডিম না ফুটিয়েই বেরিয়ে আসার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু না, শেষপর্যন্ত আর সেটা পারেনি। একটা ভালবাসা অনুভব করেছিল হৃদয়ে। এতদিন ধরে বুকের ভালবাসার ওমে জড়িয়ে রাখা ডিমগুলো ফেলে উঠে আসার মত মনের জোর তার হয়নি।

একে একে দশদশটি হাঁসের ফুটফুটে ছানা আলতো ভালবাসার ঠোঁটে ঠুকরে ঠুকরে ফুটিয়েছিল। হাঁসের ছানারা কখনই বুঝতে পারে নি মুরগী মা তাদের প্রকৃত মা নয়। আর তারা জানবেই বা কী করে? তারা তো কখনও তাদের স্বজাতির চেহারা দেখেইনি।

মুরগী মা ছানাদের লালনপালন করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল ছানারা আসলে ওর নয়।

কিন্তু মুরগী জানতো একদিন ওরা ওদের জীবনে চলে যাবে। ভুলে যাবে ওদের বিজাতীয় মায়ের কথা। যতই ভালবাসা দাও না কেন, পর কখনও সত্যিকারের আপন হয় না।

– ওমা মা, আমরা একটু জলে নামি!- ছানারা আবার সমস্বরে আবদার করে মাকে।
-ডুবে যাবি বাছারা। পুকুরে অনেক জল যে।
– না মা, ডুববো না।
-সাঁতার না জানলে ডুবে যেতে হয়।
পুকুরে নামা থেকে বিরত রাখার জন্য মুরগী মা বলে। যদিও মুরগী জানত- হাঁসেরা জন্মসুত্রেই সাঁতারু। জলই ওদের প্রিয় বিচরণক্ষেত্র।

-আমরা তো সাঁতার জানি বলেই মনে হচ্ছে।
সবচেয়ে বড় ছানাটি বলে। আর একসাথে সব ছানাই তাকে সমর্থন করে।
মুরগী মা আর ছানাদের আটকায় না।
– যা। তবে সাবধান।
– তুমি একদম ভয় পেয়ো না মা। আমরা ডুববো না।
– আচ্ছা যা, তবে তাড়াতাড়ি উঠে আসিস।

হাঁসছানারা সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। মেতে ওঠে জলকেলীতে। এতদিন পরে ওরা যেন স্বাদ পায় নিজস্ব আর প্রকৃত জীবনানন্দের।

মুরগী মা অপলক দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে- কখন তার কোলে ফিরে আসবে ছানারা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. সুমন আহমেদ : ০১-১১-২০১৯ | ৪:৫৫ |

    আপনার অণুগল্পের সরলতা ভালো লাগে কবি। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ০১-১১-২০১৯ | ৪:৫৭ |

    অসাধারণ মি. শংকর দেবনাথ। শুভ সকাল।

    GD Star Rating
    loading...
  3. নাজমুন : ০১-১১-২০১৯ | ২১:০৮ |

    গ্রামে মুরগী মা দের দেখতাম হাঁসের বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।পলকে ছেলেবেলায় ফিরে গেলাম।ভালো লাগলো।ভালো থাকবেন।  

    GD Star Rating
    loading...
  4. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০২-১১-২০১৯ | ৩:৫৯ |

    * চমৎকার….

    GD Star Rating
    loading...
  5. ছন্দ হিন্দোল : ০২-১১-২০১৯ | ৮:০৩ |

    কখন কোলে  ফিরবে ছানারা দারুণ অনুভব কবি

    GD Star Rating
    loading...