মার্চের দিনগুলো...

মার্চের দিনগুলো…

এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেল বাবার চিৎকারে। সবাইকে একত্র করে অদ্ভুত একটা আল্টিমেটাম দিলেন, দুই ঘণ্টা সময় আমাদের হাতে এবং এর ভেতর যেভাবেই হোক শহর ছাড়তে হবে সবাইকে। কারণ দর্শানো নয়, অজুহাত নয়, স্রেফ আদেশ। কোথায় যাব এবং কেন যাব প্রশ্ন করার প্রয়োজন ছিলনা, বাবার গলার আওয়াজ শুনেই বুঝে নিয়েছি কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে শহরে। ছোটকাল হতেই জেন এসেছি বাবা যা বলবেন তা ঘটতে বাধ্য। এ যাত্রায় তার ব্যতিক্রম হবে মনে করার কোন কারণ ছিলনা। বিষণ্ণ হয়ে গেল বাড়ির পরিবেশ। ভয় ভীতির চাইতে অনিশ্চয়তা গ্রাস করে নিলো আমাদের। স্কুল যাওয়া হয়না সেই মার্চ মাস হতে। হেড স্যার অনেক চেষ্টা করেও কাউকে ভেড়াতে পারেননি ওদিকটায়। আসলে স্কুলে যাওয়ার সময় ছিলনা ওটা। পরিচিত পরিবেশ বদলে যাচ্ছিল প্রতি ঘণ্টায়। দেশে বিশাল কিছু ঘটতে চলছে প্রথম নিশ্চিত হলাম যেদিন রেডিওর নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে গেল। ’জয়বাংলা বাংলার জয়, হবে হবে হবে নিশ্চয়‘, গানটা শুধু রাস্তাঘাটে বাজতে শুনেছি এতদিন। এমন একটা গান রেডিওতে বাজবে স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। কিন্তু তাই হল, এবং এর মধ্য দিয়ে ঘোষিত হল নতুন এক শুরুর। এ শুরুটা ছিল বিদ্রোহের তা বুঝতে কারও বাকি রইল না। আমার মত স্কুল ছাত্রের পক্ষেও বুঝতে অসুবিধা হল না জীবন বদলে গেছে আমাদের।

২৬ শে মার্চ ১৯৭১ সাল। পূব দিগন্তে সূর্য উঠি উঠি করছে কেবল। দাবানলের মত ছড়িয়ে পরল খবরটা, ঢাকা শহর আক্রমণ করেছে পাকিস্তানিরা। খুব সকালে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল শহরের রাস্তাঘাট। মোড়ে মোড়ে জটলা আর হরেক রকম জল্পনা কল্পনা। কেউ কেউ জানালো রাজধানীতে এত রক্ত বইছে যার উপর নৌকা চালাতেও না-কি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোন ছাত্রকেই না-কি রেহাই দেয়া হয়নি। টিএসসি আর মধুর ক্যান্টিনে নাকি ট্রাকের পর ট্রাক আসছে লাশ নিয়ে। বাতাসে শুধু খবর আর জল্পনা। লোকজন এক জটলা হতে অন্য জটলায় ঝাপ দিচ্ছে নতুন খবরের আশায়। সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকাগামী বাস গুলো হাত পা গুটিয়ে বসে রইল।

সময় গড়ানোর সাথে সাথে জেগে উঠল শহরের মানুষ। ঢাকায় আসলে কি ঘটেছে তা জানার উৎকণ্ঠায় অনেকেই রওয়ানা দিতে চাইল শহরের দিকে। দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় এমপি এবং আওয়ামী নেতৃবৃন্দের চাপে নড়ে উঠল মোমিন কোম্পানির বাস গুলো। দুপুর ২টার দিকে শুরু হল মানুষের স্রোত। বাস, নৌকা, লঞ্চ এবং পায়ে হেটে ওরা আসতে থাকল। শিশু, কিশোর, বৃদ্ধা, ধনী, গরীব, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, ছাত্র, গায়ক, নায়ক সহ সবাই যোগ দিতে বাধ্য হল পালানোর মিছিলে। শহরের কোনায় কোনায় গড়ে উঠল আশ্রয় কেন্দ্র। খাদ্য এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হল যুব সমাজের উপর। চাল ব্যবসায়ীরা এগিয়ে এলো চাল নিয়ে, তরকারী ব্যবসায়ীরা তরকারী নিয়ে, এগিয়ে আসার মিছিল হতে কেউ পিছিয়ে থাকতে চাইল না। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গোটা শহর রূপান্তরিত হল শরণার্থী শিবিরে। সন্ধ্যার দিকে এ ক্যাম্পে নাম লেখাল সিনেমার নায়ক জাফর ইকবাল এবং তার ভাই আনোয়ার পারভেজ। উত্তেজনায় টগবগ করছে গোটা শহর। দম ফেলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই কারও। ঢাকা হতে পালিয়ে আসা অনেকের মুখে শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে অনেক রকম কথা শোনা গেল। একজন বলল সে নাকি নিজে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের মোড়ে শেখ মুজিবের লাশ ঝুলতে দেখেছে। অনেকে দাবি শেখ মুজিব পায়ে হেটে তারাবো পর্যন্ত এসে অন্য কোথাও চলে গেছেন। মোট কথা কথার কোন লাগাম রইলো না, যার মুখে যা আসলো তা অবলীলাক্রমে বলে গেল।

২৭ তারিখ সকাল হতে শহর সরগরম হয়ে উঠল ইপিআর বাহিনীর আনাগোনায়। আর্মড জিপে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ওরা চষে বেড়াল শহরের প্রতিটা গলি। আমরা শুধু হা হয়ে দেখে গেলাম এবং মনে মনে ধরে নিলাম স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা। এভাবেই কেটে গেল মার্চের শেষ কটা দিন। বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার সহায়তায় ততদিনে জানা হয়ে গেছে শেখ মুজিবের ভাগ্য। এত সহজে আমার স্কুলে ফিরে যাওয়া হচ্ছে না এপ্রিলের শুরুতে তা পরিষ্কার হয়ে গেল। এপ্রিলের ১ এবং ২ তারিখ দুটো অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটল আমাদের শহরে। মুচি পাড়ার ১০/১২ জন নীরিহ অবাঙালীকে মেঘনা নদীর হাঁটু পানিতে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করল স্থানীয় কজন আওয়ামী লীগ নেতা। একদিন পর শহরের সবকটা ব্যাংক লুট হয়ে গেল। এ লুটে অংশ নিলো ইরান ভাই (বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা), আপেল ভাইয়ের (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গায়ক আপেল মাহমুদ) মত বিশিষ্ট নেত্রী বৃন্দ, সাথে ছিল রতন মোল্লার (বিএনপির এককালীন শিল্প বিষয়ক সম্পাদক রোকনুদ্দিন মোল্লা – আরএম শিল্প গুষ্টির মালিক) মত সুযোগ সন্ধানীর দল। বাতাস ভারী হয়ে গেল শহরের। অনেকেই আশংকা করল পাকিস্তানী প্রতিশোধের। এমন একটা প্রেক্ষাপটেই বাবার আল্টিমেটামে শহর ছাড়তে বাধ্য হলাম আমরা।

কথা ছিল অবস্থা একটু ভালোর দিকে মোড় নিলেই ফিরে আসবো সবাই। কিন্তু আমরা কেউই ধারণা করতে পারিনি বাড়ি ফিরতে আমাদের আরও ৮ মাস দেরী হয়ে যাবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৭ টি মন্তব্য (লেখকের ৮টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. শাকিলা তুবা : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৩৭ |

    শহরের সবকটা ব্যাংক লুট হয়ে গেল। এ লুটে অংশ নিলো ইরান ভাই (বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা), আপেল ভাইয়ের (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত গায়ক আপেল মাহমুদ) মত বিশিষ্ট নেত্রী বৃন্দ, সাথে ছিল রতন মোল্লার (বিএনপির এককালীন শিল্প বিষয়ক সম্পাদক রোকনুদ্দিন মোল্লা – আরএম শিল্প গুষ্টির মালিক) মত সুযোগ সন্ধানীর দল। বাতাস ভারী হয়ে গেল শহরের।

    সেই সময় সুযোগ সন্ধানীদেরও অভাব ছিলো না !! Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:০৮ |

      এই লুটেরার দলের জীবন কাহিনী অনেকদূর গড়িয়েছিল। ওদের অনেকেই এখন নেই। কিন্তু তাদের লুটের কাহিনী এখন কেউ মনে করতে চায়না। কারণ এরা সবাই রাজনৈতিকভাবে ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৪০ |

    যাপিত জীবনের ইতিহাস।

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১৪ |

      এবং এখনো তাজা!

      GD Star Rating
      loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৪৩ |

    পড়লাম ওয়াচডগ ভাই। স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানবেন। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হোক। 

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:০৯ |

      আপনার জন্যেও শুভেচ্ছা। ধন্যবাদ।

      GD Star Rating
      loading...
  4. সুমন আহমেদ : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৪৫ |

    এমন বিভীষিকা পরিস্থিতির গল্প আমি আমার পরিবার থেকেও শুনেছি। 

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১০ |

      সত্য বলার নজির এখন বিরল।

      GD Star Rating
      loading...
  5. রিয়া রিয়া : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৪৮ |

    কত সহস্র মানুষ এভাবেই নিশ্চিত অনিশ্চয়তায় পালিয়ে বেড়িয়েছে। আহা।  Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১০ |

      ওরা সংখ্যায় ছিল ১ কোটির উপর!

      GD Star Rating
      loading...
  6. ফারুক মোহাম্মদ ওমর : ২৫-০৩-২০১৯ | ২৩:৫৯ |

    মাথা নত হয়ে আসে।

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১১ |

      ইতিহাস আমাদের.. এনিয়ে দুঃখ, কষ্ট, গর্ব সবই আমাদের!

      GD Star Rating
      loading...
  7. নিতাই বাবু : ২৬-০৩-২০১৯ | ১:২৩ |

    আমার এখনো সেই অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১-এর কথা স্পষ্ট মনে আছে। প্রতিবছর এই মার্চমাস আসলেই আরও বেশি করে মনে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার এক মামাকে হারিয়েছি। এরপর নিজেদের ভিটেমাটিও হারিয়েছি। মনে পড়ে, খুব মনে পড়ে।

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১৩ |

      ইতিহাসের বয়স বাড়েনা…তরতাজা হয়তে বার বার ফিরে আসে আমাদের মাঝে

      GD Star Rating
      loading...
  8. ফারুক মোহাম্মদ ওমর : ২৬-০৩-২০১৯ | ১৯:২২ |

    বারুদের ইতিহাস।

    GD Star Rating
    loading...
    • ওয়াচডগ : ২৭-০৩-২০১৯ | ৭:১৩ |

       এবং রক্তাক্ত!

      GD Star Rating
      loading...
  9. নিজু মন্ডল : ২৯-০৩-২০১৯ | ১৮:১২ |

    সুন্দর স্মৃতিকথা। তবে ব্যাংক লুটের ঘটনা বুঝলাম না। এর পেছনে ভালো কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে(মানে টাকাটা যুদ্ধের কাজে ব্যয় হতেও তো পারে)

    GD Star Rating
    loading...