মস্তিষ্কের ফাঁকা পাকস্থলী
আশি বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “সভ্যতার সংকট”। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তাকে চেয়ে এসেছে গোটা পৃথিবী, নতুন এক মানবিকতা, এক বিশ্বাসযোগ্য আশাবাদের প্রবক্তা হিসেবে। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন, সত্য ও সুন্দর কি মানুষের মনন-উচ্চতার অনেক ওপরের জিনিস? না — রবীন্দ্রনাথের সপাট উত্তর।
তখন বিপ্লবী চায়না থেকে জাপান, গোটা ইওরোপ ঘুরে বেড়িয়ে বক্তৃতা দিতে হচ্ছে কবিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো যায়নি ঠিকই, তবু রোমা রোলাঁ, এইচ জি ওয়েলস…পৃথিবীর প্রধান চিন্তাবিদরা তার আদর্শবোধে আস্থা রেখে আত্মজিজ্ঞাসু হতে চেয়েছেন। নানা দেশে এমন উদাহরণের অভাব তো নেই। ফরাসি বিপ্লবের তাত্বিক নেতা ছিলেন রুশো, ভোলতেয়ার, দিদেরা আর সেই ফ্রান্সেরই ১৯৬৮-র ছাত্র আন্দোলনের প্রধান আদর্শবাদী মুখগুলো সার্ত, রোলাঁ বার্ত, মিশেল ফুকো…। শুধু রবীন্দ্রনাথকেই, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল যেমন লিখেছেন, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুই দুনিয়ার দায় নিতে হয়েছিল।
অথচ, আমরা নিজেদের রাজ্যের দিকে একবার ফিরে তাকাতে অনিচ্ছুক, অক্ষম।
নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলনের সময় কিছু বাঙালি ভাবুক চিন্তাবিদ একসাথ হন। মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক আন্দোলন এক তাত্ত্বিক পটভূমি পাবে, যা ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়টার বাইরে গিয়ে ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা নিয়ে রাখবে আলাদা কিছু প্রস্তাব। সততা আর স্বার্থচিন্তার দ্বন্দ্ব থেকে নতুন এক জীবনপ্রক্রিয়া বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। আমরা পরে বুঝেছি, ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডার বাইরে প্রায় কেউ ভাবেননি। যে কয়েকজন দলভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদের মধ্যেও প্রসঙ্গের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠার রসদ ছিল না।
এখন অবস্থা আরও করুণ ও বিপজ্জনক। অন্ধকার যেভাবে আলোর অভাব, আজকের দুর্নীতি, ক্ষমতাকে ঘিরে উন্মত্ততা আসলে চিন্তার সার্বিক এক শূন্যতারই ছবি। সেই শূন্যতা শুধু ধর্ষণকারী বা গরীবের অর্থ আত্মসাৎ করা মানুষগুলোরই অসুখ নয়, ঘটনা নিয়ে আলোচনার আসর জমানো টিভি চ্যানেল আর তার সামনে বসে থাকা শ্রোতারও। এক দল যে-কোনও উপায়ে মসনদে টিঁকে যেতে আর অন্য দল যে-কোনওতর কায়দায় কুর্শির দখল নিতে ঝাঁপ দিয়েছে। তাই কোথাও কোনও বদলের আশা থাকে না। সমাজের প্রত্যেকটা এজেন্সি ঠিক ভাড়াটে সৈন্যের মতো নিজের পারফরমেন্স শেষে চুক্তির টাকা গুনে নিয়ে সরে পড়ে। মনে হয়, রাজ্যের সমস্ত মানুষের উচ্চতা একই। অন্যায়, অন্যায়ের খবর, অন্যায়ের প্রতিবাদ, অন্যায়ের তদন্ত, অন্যায়ের বিচার — যেন একই অপরাধের শিমূলবীজ থেকে জন্ম নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে।
কবি-শিল্পী নয়, একজন চিন্তাবিদ চাই আমাদের এই সময়ে। ফাঁকা, ভিতু, অসহায় মাথাগুলো নতুন কিছু আইডিয়া, আদর্শ, দর্শনতত্ব চায়। মস্তিষ্কের পেট অভুক্ত আছে কতদিন যে!
জীবনের একজন ভাষ্যকার দরকার, এক প্রবক্তা, যিনি এই কর্দমাক্ত অন্ধকার থেকে টেনে তুলবেন আমাদের, মননের আতুর বিছানা থেকে। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না। এদেশ, ওদেশ…গোটা পৃথিবী আশ্চর্য জনশূন্যতার মধ্যে পড়ে আছে!
loading...
loading...
অনন্য এবং স্বকীয় ধারার লিখা। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা। শুভেচ্ছা রইলো।
loading...
অসাধারণ বিন্যাস পড়লাম চন্দন দা।
loading...
ইতিহাসের চমৎকার বিশ্লেষণ। শুভেচ্ছা প্রিয় চন্দন দা।
loading...