ভেলৌরযাত্রীর ডায়েরি


তখন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সদ্য জন্ম নিল। বাঙালি হিন্দুর ঠোঁট ওলটানো ভুরু কোঁচকানো অংশটা তার রিলিজিয়াস অপোজিটকে মনে মনে ভয়-রাগ-সন্দেহ-ঠাট্টা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এমন কিনারাশায়ী করে ফেলেছে, চোখের সামনে তাদের টুপটুপ করে ঝরে পড়তে যে দেখছি না, সে শুধু পৃথিবীটা গোল বলেই।

এমন একদিন অফিস-ফেরতা হানা লাগালাম রাতের বাজারে, ফল কিনবো। দোকানদার বলল, আজ টাটকা পেয়ারা আছে, নিয়ে যান। ওমনি এক মানুষ, দাড়ির ভঙ্গিমাটি যেন মুসলমান, যিনি ওই দোকানের দরজাতেই দাঁড়িয়ে, বাছতে শুরু করলেন। মালিক আবার বলল, ওরই বাগানের পেয়ারা। মুসলিম ভদ্রলোক ৪-৫টা পাল্লায় তুলে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, খেয়ে কাল এখানে বলে যাবেন কেমন টেস্ট। নিজের গাছের ফলের প্রতি বিশ্বাস তার চোখেমুখে খুব স্পষ্ট লেগে আছে। ধন্যবাদ দিলাম, ফল ব্যাগে পুরে চলে আসার সময় আবার বললাম, আসি দাদা।
একগাল হেসে ভদ্রলোক আমার ডান হাতটা কনুই পর্যন্ত জড়িয়ে ধরলেন দুহাতে। মনে হল, আদতে পৃথিবীর কোনও বিপজ্জনক কিনার না থাকলেও তিনি তাকে বর্গ বা আয়তক্ষেত্র বলে অনুভব করেছেন। তার চোখে ছিল বৃত্তাকার ভালোবাসায় আবার গৃহীত হবার কৃতজ্ঞতা।


পকেটে পয়সা থাকলেই আমি গীতাবাক্য না মেনে ফলের আশা করে থাকি, ফলত, ফলের সঙ্গে উপ্রি কিছু ফললাভ হয়েও যায় মাঝেমধ্যে। ভেলোরেই সেদিন যা ঘটল। যে-হোটেলে থাকি তার সামনের দোকান থেকে বেদানা বেছে কেনার জন্যে তিরিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলাম, দোকানদার বলল, অতো বাছলে বিক্রি নেই, কেটে পড়ুন।

“পো” বলে সংক্ষেপে গেট আউট বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তামিল জনজাতি। শুনে ‘পেলাস্টিক’-এ খুবই আঘাত লাগল। রাগ করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোলাম ওখানকার প্রাচীন বাজার নেতাজী মার্কেটে। তারপর একটা দোকানে ফেজটুপি মাথায় ফলওয়ালা দেখে সোজা হাজির সেই দরবারে (ছোটবেলা থেকেই মেহেন্দিকরা দাড়ি বা গলায় রুপোলি ক্রশ দেখলেই কেমন যেন চাঁদে হাত পেয়ে যাই)।

তখনও কি জানতাম আগের ভেলোরিয় দোকানদারের অ্যান্টোনিমে পৌঁছে গেছি? নিজেরই দোকানের আপেল, অথচ পৌনে এককেজি বাছতে গিয়ে তার কিছুতেই পছন্দ হয় না। নাহ্, এটা ট্রান্সপোর্টে আসার সময় টোল খেয়ে গেছে, এটায় টোকা মারলে ব্যাটেবলে হওয়ার টং শব্দ উঠছে না…। তিনচারখানা আইটেম হাতে ঝুলিয়ে নাচতে নাচতে হোটেলে ফিরলাম। কয়েকদিন পরে সব সাবাড় হতে ফের সেই দোকানে।

আপেলজহুরি পুনরায় বাছাইব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আমি বললাম (কেন যে বললাম) বেদানাটাও দেখে দেবেন প্লিজ, আগেরদিন একটা পচা বেরিয়েছিল। ব’লে মুখের দিকে তাকিয়ে — এই যাঃ, ইনি তো তিনি নন! ভদ্রলোক হেসে ফেললেনঃ ঠিকই, গত শনিবার দেখেছেন আমার ওপরের ভাই মেহতাবকে। বলতে বলতে অনারের স্তূপ থেকে একটা ডিউস বল তুলে চালান করে দিলেন আমার ফলের ঠোঙায়। হাঁ-হাঁ করে উঠলাম, তারপর ‘অনুনয়-বিনুনয়’ও করতে বাকি রাখলাম কই, কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা, আপনার কাছ থেকে এই বেদানার দাম নিলে আমার ইমান রক্ষা হয় না। বে-ইমানি করতে বলবেন না দয়া করে।

ফিরে আসার আগে আর একবার তাকিয়ে দেখলাম মুখটায় —
এই দুনিয়াদারির মধ্যে দাঁড়িয়ে ইমানদারি দেখাচ্ছো? বাবু, তুমি সত্যিই সংখ্যালঘু…!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১২-১১-২০১৮ | ১৪:৫৪ |

    অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সচরাচর কম দেখি। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা। ভালো থাকুন। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ১২-১১-২০১৮ | ১৮:২০ |

    আমাদের ভারত !! সত্যই অবাক আমাদের ভারত চন্দন দা !! দারুণ অভিজ্ঞতা। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  3. রুকশানা হক : ১২-১১-২০১৮ | ১৯:৫০ |

    চমৎকার অভিজ্ঞতা।  আসলেই ঈমানদাররা সংখ্যালঘু । ক'জন এমন আছে আজকাল ।

    GD Star Rating
    loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১২-১১-২০১৮ | ২০:৫২ |

    অসাধারণ অভিজ্ঞতা চন্দন দা। ভীষণ আগ্রহ ভরে আপনার লেখা পড়ি। আমাদের শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর টুকু আমরা পাঠক প্রত্যাশা করতে পারি।
    ঠিক নয় কি?

    প্রকাশিত পোস্ট : ১৮৭
    মন্তব্য পেয়েছেন : ৩৯ জনের
    মন্তব্য দিয়েছেন : ০ জনকে। Frown

    GD Star Rating
    loading...