সমস্যা: যতিচিহ্ন পরিবর্তন করুন বা বাদ দিন

tr

প্রাবন্ধিক সুশান্ত বর্মন বলেন, দর্শনের প্রধান দুটি শাখাতেই মানুষের প্রাচীন ইতিহাসের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাববাদী মতে সুদূর অতীতে ‘সত্যযুগ’ নামে এক কাল ছিল। সেসময় সবাই ছিল সত্যবান। কেউ কোনো মিথ্যা কথা বলতো না, কোনো অসৎ কাজ করতো না। এখনও এদেশের সাঁওতাল, গারো, ওঁরাও প্রমুখ প্রত্নমানুষদের অভিধানে ‘পরশ্রীকাতরতা’, ‘ধর্ষণ’ প্রভৃতি শব্দ অপরিচিত।

আধুনিক বস্তুবাদী মতে ইতিহাসপূর্বকালে ‘আদিম সাম্যবাদী সমাজ’ নামে একটি প্রাকৃতিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সে সমাজে সকল মানুষ সমান ছিল। কেউ কারও তুলনায় কোনো অজুহাতে বিশিষ্ট ছিলনা। প্রামাণ্য ইতিহাস হিসেবে এর কোন ক্ষণ স্বীকৃত নয়, তাই বলে সুস্থ সমাজের এই ধারণাটি আমাদের কল্পলোক পরিত্যাগ করেনি। এই চিরনতুন, চিরকাঙ্খিত, আনন্দময় ও ধ্রুপদী স্বপ্নলোকের রশ্মিপ্রকাশ স্বদেশে সমকালে বিলুপ্ত। স্বকালের যাবতীয় মিথ্যাচার, প্রবঞ্চনা, অনৈতিকতা, অসঙ্গতি, সহিংসতা অর্থাৎ সার্বিক স্ববিরোধীতা মানুষের মানসলোকে আজ বেকেটের দুঃস্বপ্নগুলোকে মূর্ত করে তুলেছে। ফলে শিল্পজগতের সবখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক বিরান মরুভূমি। বাংলাদেশের কাব্যজগতও এই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারেনি। আশির দশকের শেষাংশে এবং নব্বই দশকে এসে এই বন্ধ্যাত্বের কিঞ্চিত উপশম আমরা অনুভব করি। চারপাশের উষর কাব্যমাঠের মাঝে মাঝে কিছু মরুদ্যান- সদৃশ সবুজ বাগান আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে থাকে। এরকমই একটি তৃণভূমি সৃজন করেছেন কবি লেখক মাসুদ খান তাঁর ‘পাখিতীর্থদিনে’ কাব্যগ্রন্থে।

মাসুদ খানের কবিতাপাঠে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে তিনি যেন কবিতার জন্যই কবিতা লিখেছেন। তিনি যেন Art for Arts shake এর বীজকে নিজের মগজে গেঁথে নিয়েছেন। কিন্তু সন্ধানীপাঠক মাত্রই জানেন মাসুদ খান এত স্থূল নন। বরং ত্রিকালদর্শী প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি এঁকেছেন ভবিষ্যতের কাল।

এই ভারতভূমির সার্বিক অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রথম প্রমূর্ত বিদ্রোহ করেন গৌতমবুদ্ধ।
“সার্থবাহ নিয়ে আসে ঝলমলে বাসকপাতার কোলাহল
দুঃখ সেরে যায়, অসুখ সারে না।” (বৈশ্যদের কাল)
এই বাস্তবতায় বুদ্ধ নির্ভার-নিশ্চিত থাকতে পারেননি। মানুষের জীবন আঁকড়ে থাকা সমস্যা সমাধানের দুর্মর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে জাগিয়ে তোলে বিলাস জীবন থেকে। এক সুন্দর স্বপ্নের আশায় তিনি বেড়িয়ে পরেন রাজপুত্রের খোলস থেকে।

“…একদিন ঘুমন্ত স্ত্রী আর পুত্র রেখে ঘন রাত্রে
নিরুদ্দেশে যায়
নিরঞ্জনা নদীকূল শুধু কাঁপে অকূল তৃষ্ণায়।
ধীরে ধীরে এই ভূমিপৃষ্ঠে ফিরে এলো বৈশ্যদের কাল
…ধুলিঝড় হলো, হিমবাহ গেলো শতযুগ।”

তারপর বোধহীন বোধির আক্রমণে বুদ্ধের বোধি এই ভূখণ্ডে ক্রমাগত রঙহীন নির্জীব হয়ে যায়। শুধু ইতিহাসে লেখা হয়ে থাকে-
“ঐখানে হৈ হৈ রৈ রৈ পঞ্চকাণ্ড মেলা বসতো
হাজার বর্ষ আগে
আজ শুধু এক জোড়া নিরিবিলি জলমগ্ন বৃক্ষ বাস করে।”

মানুষ প্রথমত এবং প্রধানত বস্তু। তাই সে বেশিরভাগ সময়ই চরম বস্তুবাদী। বস্তুকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে; শ্বাস হিসেবে শরীরের ভিতরে প্রবেশাধিকার দেয়। বস্তু দিয়ে লেখে, বস্তু পড়ে, বস্তু ব্যবহার করে; তাঁর চারপাশের যা কিছু গ্রহণযোগ্য তার সব কিছুই বস্তু। এমন চরম বস্তুবাদী মানুষকে আধ্যাত্মবাদ বিচার করে ভিন্নভাবে।

প্রাণীজগতের সবচাইতে বুদ্ধিমান জীব মানুষের দিকে কবি তাকাতে চান যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে। কিন্তু মাসুদ খান দেখেন সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন দর্শন মানুষকে বিশ্লেষণ করতে চায় ভিন্ন উপায়ে। মানুষের প্রচলিত ও বহুল বিবৃত কোন কোন সংজ্ঞায় বিব্রত বোধ করেন। মানুষ সম্পর্কিত দার্শনিক তত্ত্বগুলো তাঁর মনে ভিন্ন অনুভূতির সৃষ্টি করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বহির্জগতের ভিত্তিতে নয় অন্তর্জগতের ভিত্তিতেই মানুষকে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ‘মানুষ’ নামে উপস্থাপন করেছেন তিনটি কবিতা।
প্রথম কবিতায় তিনি মানুষকে সেমেটিক মীথের প্রতিফলনে খুঁজেছেন। ব্যর্থ ইঁদুরশিকারী (যে আবার ইঁদুরছানার কাতর চোখ দেখে শিকারে ক্ষান্ত দেয়), দুধমাছচোর, উঞ্ছজীবী বিড়ালকে উত্যক্ত প্রতিপালক দূর বালিচরে বস্তাবন্দি করে ছেড়ে দেয়। বিতাড়িত বিড়াল নিরিবিলি জীবন থেকে উৎপাটিত হয়ে নির্বাসিত হয় মরুরঙ চরভূমিতে।
মানুষ নামাঙ্কিত দ্বিতীয় কবিতাতেও তিনি মানুষকে দেখেন সেমেটিক আয়নায়। এখানে মানুষ চিহ্নিত হয়েছে আপেল চোর হিসাবে। পেছনে তাড়া করা সাপের ফণা ক্লান্ত চোর মানুষটিকে শান্ত থাকতে দেয়না। কবি মানুষের এমন হীন সংজ্ঞায় বিব্রত; এমন বিকটভাবে বিশেষায়িত নিজেকে স্থাপন করবার জন্য পাত্র খুঁজে পাননা। ‘মানুষ’ শীর্ষক তৃতীয় কবিতাটিতে কবি মানুষের এমন পূর্বনির্ধারিত অপমানকর বিশেষণকে প্রত্যাখ্যান করেন। সরাসরি অস্বীকার করেন নিজের আরোপিত চোরবংশজাত ঐতিহ্যকে।

“তোমাদের এই বংশের কেউ নই,
না তস্করকুলের কেউ।” (মানুষ)

নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি জেনেছেন প্রাতিষ্ঠানিক দাসদের মানসদিগন্ত। প্রতিষ্ঠানপ্রেমিক আমরা দাসখত লিখেছি জীবন ও সমাজের কাছে। জেনেছি মর্ম সত্য নয় রূপ সত্য। আমাদের কাছে এযুগে প্রকল্পব্যবসা মর্যাদা পায় সমাজসেবা বলে। ফলে-

“বীজায়ন প্রক্রিয়া, তারও পূর্বপার থেকে
জন্মদিন ভেঙেচুরে, দেহ তো হয়ই নি, দৌড়ে আসে সীমারেখা।
প্রকল্পের প্রভাবে জোরালো সোডিয়াম জ্বলে।” (প্রতিষ্ঠান)

বস্তুবাদী কবির উপলব্ধি বড়ই অমোঘ ও নির্মোহ। তাই প্রাত্যাহিক জীবনের শত দুঃখ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা থেকে আড়াল পেতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত জপ করার জন্য প্রদান করেন একটি সত্যমন্ত্র-
“শ্রবণ বধির ক’রে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।”

t
m1 m2
কবিঃ মাসুদ খান ( জন্মঃ জয়পুরহাট ২৯/০৫/১৯৫৯ )
কৃতজ্ঞতায়ঃ সুশান্ত বর্মন। প্রাত্যাহিক পায়চারি ব্লগ।
থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।

সঠিক লিন্ক সহায়তায় শ্রদ্ধেয় অ-সামাজিক ব্লগার। তাঁকে জানাই ধন্যবাদ।
আজ প্রথম পর্ব। আগামী পর্বে সমাপ্য।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

কোন মন্তব্য নেই

মন্তব্য বন্ধ আছে।