”চোখ গেল-তার ভরসা তবু আছে-
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে!” *
নিজের ভূবনে একা এক বধু। আলো আঁধারির মাঝামাঝি বসবাস। নিজের রুমে অলস সময়ে ভেসে যাওয়া এক অন্ধবধু! অনুভূতিতে প্রবল – প্রকাশে অক্ষম এক নারী। সবার মাঝে থেকেও অদৃশ্য এক মানবী। মায়াবী-কোমল! যেন নরম রোদ্দুর! মনের চোখের সেই চিরচেনা নিজের গ্রাম ছেড়ে ছ’মাস হল ইটপাথরের এই নগরের বাসিন্দা। ওর জামাই বন্ধু নতুন এই ফার্মে যোগ দেবার পর, গ্রামে বিলি বন্দোবস্ত করে, আপাতত সেখানের পাট চুকিয়েছে। তার বাবা মা আর বোনকে নিয়ে এখনকার এই ফ্ল্যাটটিতে অস্থায়ী নিবাস।
‘জীবনে কখন যে নিজের স্থায়ী এক বাড়ি হবে!’ বধু ভাবে। চলার কি কোনো শেষ নেই ?
বাড়ির কথায় মনে পড়ে গেল একজন মানুষের কথা। ওর নিজের মানুষ। বর। অন্ধবধুর জামাইবন্ধু। নিঃশব্দে হাসে বধু। অন্ধদের কোনো বন্ধু হয় না। আলোর বিপরীতে আঁধার। আঁধারের সাথে কে বন্ধুত্ব করতে আসে।
পারুলের আজন্ম লালিত এই ধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল শিহাব। মনে পড়ে প্রথম দেখা (অনুভবে) হবার দিনের কথা। চাচারা বাবা-মা হারা এই অন্ধ উপদ্রবকে পার করার জন্য এক ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছিলেন। পারুলের অন্ধত্ব কে তারা লুকিয়েছিলেন। সেজন্য তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজন ও করেন। বিয়ের আসরেই অন্ধ মেয়ের পরিচয় প্রকাশ হলে শিহাবের বাবা-মা এবং অন্য আত্মীয় স্বজনেরা বেঁকে বসেন। এক অন্ধ মেয়ের দ্বন্দ্ব ঘুচাতে তখন এক শিহাবই এগিয়ে এসেছিল।
কেন এসেছিল সেদিন শিহাব? আজো জানা হল না।
গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন শহরের মেসে থাকা শিহাব কালেভদ্রে বাড়িতে আসতো। একমাত্র ননদ ই ছিল তখন পারুলের অবলম্বন। নিজের দিকের আত্মীয়দের হঠকারিতার জন্য বিগত দিনগুলোতেও শাশুড়ির কথার বাণে যেমন জর্জরিত হত, এখনো সময়ে অসময়ে হতে হয়। নিজের চারপাশের আঁধারের পর্দা সরিয়ে স্মৃতির চাদরে হাত রাখে অন্ধবধু। অনুভবে স্মৃতির বুকের কোমলতায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চায়। বিষণ্ন বিরহী দীর্ঘশ্বাসগুলো নিরবে পাক খেতে থাকে জণাকীর্ণ একটি তিনরুমের ফ্ল্যাট ঘরের এক অন্ধ নারীর কক্ষে।
তখনো যেমন শিহাবের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে- এখনো করছে… সেই একই ভাবে। তখন এক কিশোরি বধু বিভিন্ন পার্বনে তার প্রিয় মানুষটির অপেক্ষায় কুহকী প্রহর গুনতো। জষ্ঠি কবে আসবে? আমের বরণ দেখে কারো ফিরে আসার মুহুর্তকে চিহ্নিত করতে চাওয়া… কোকিলের ডাকের রেশ মিলাতেই নববধুর হৃদয়ের জানালায় দখিন হাওয়া বন্ধ হবার বিদায়ী বার্তার আগমনী পাঠ- কিভাবে যেন পড়া হয়েই যেত। কিন্তু শিহাবের না ফেরায় বালিকা বধুর মনে অভিমান কষ্ট সব মিলেমিশে একাকার হত। কাল বোশেখের উত্তাল ঝড়ের রাতগুলি ছিল কিশোরী পারুলের কাছে দীর্ঘ… মুহুর্তগুলি অসহ্যকর…কখনো মনে হত- দীঘির ঘাটে জেগে ওঠা শ্যাওলায় পিছল নতুন সিঁড়িতে পা পিছলে তলিয়ে যেতে… মায়ের কোলে শান্তিতে ফিরে যেতে। কিংবা কোনো এক বেতের বনের ধারে, ডাহুক ডাকা এক সাঁঝ বেলায়, খেলা শেষে বেলাশেষের নীড়ে ফিরে যেতে! কিন্তু বুকের ভেতরে বাস করা কিছু গোপন ইচ্ছের অপমৃত্যু ঘটাতে চায়নি বলেই আজো ওর দ্বন্দ্ব ঘুচেনি।
পাথরে ছেনি হাতুড়ির কোমল কঠোর আঘাতে শিহাব নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে ভাস্কর্য বানায়। নিজের ভূবনে এক অন্ধবধু পারুল- সেগুলোকে নিজের হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে। তাই দেখে শিহাব একদিন বলেছিল, ‘তোমাকে পাথরে রুপ দেবো! ‘ সেকথা শুনতেই যেন কেমন লেগেছিল সেদিন! ঘর ভর্তি শিহাবের বানানো বিভিন্ন আইটেম…সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে বধু শিহাবকে অনুভব করতে চায়। ওর অনুপস্থিতির সময়গুলোতে পাথরে যেন প্রাণ চলে আসে।
এই শহরে সুস্থ মানুষেরাই দম নিতে পারে না। জীবনের প্রয়োজনে চলছে অসম প্রতিযোগিতা। লোভ লালসার চক্রব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসা এখানে এক অলীক কল্পনা। এই বিবর্ণ নগরে এক অন্ধমেয়ে কিভাবে তার হৃদয়ের রঙগুলো দিয়ে নিজেকে বর্ণময় করে? শিহাব যদিও সবকিছুর দিকে খেয়াল রাখে, শ্বাশুড়িও ছেলের ভালোবাসা দেখে বউকে আর তেমন ঘাটান না। তবে একেবারে ছেড়েও দেন না। এভাবেই চলে অন্ধবধুর নগরজীবন।
শিহাবকে কাছে পাওয়ার সময়ে নিজের মত করেও পাওয়া হয়ে ওঠে না। অন্ধ মেয়েকে কিছু একটা অবলম্বন করে জীবন চলতে হয়। কিন্তু একজন অন্ধবধুকেও কি তাই করতে হয়? মেয়ের জীবনে অনেক কিছু থাকেনা। বধু হৃদয় আশা আকাংখার প্যান্ডোরার বাক্স। ভালোবাসাবাসির নিবিড় মুহুর্তগুলোতেও নিজের ইচ্ছেনুযায়ী চলার অধিকার নেই অন্ধবধুর। শিহাব অবলম্বন হয়… বধু নিজের মনে প্রিয় মানুষটিকে অনুভব করতে চায় নিজের মত করে… শিহাব বড্ড স্পর্শকাতর। নিজেকে যতটুকু না দিলেই নয়- এর বাইরে ধরা ছোঁয়াও সে পছন্দ করেনা।
রাতগুলোও না দিনের মত। দিনগুলোও না রাতের মত।
অসময়ের বুকে বয়ে চলা সময়ও স্থবির। শিহাব বলে গেছে, এবার ফিরেই পারুলের আবক্ষ মুর্তির কাজ শেষ করবে। ম্লান হেসেছিল সেদিন পারুল। ওর অন্ধ চোখের শুণ্যতায় জমে থাকা নিরব চাওয়াকে কি শিহাব দেখে না? আজকাল শিহাব কে কি একটু অন্যরকম লাগে ? জামাইবন্ধুর সেই বন্ধুটি কেন জানি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। শিহাব তবে কি এখন কেবলি একজন জামাই? পুরুষ! শরীরের দায় বইতেই যার একজন নারীর প্রয়োজন! বধু নয়? পারুল কি এখন কেবলি একজন নারী? একজন অন্ধনারী।
নিজের রুমে বসে গাঁয়ের এক বধু বিষণ্ন অনুভুতিতে বিভোর! যার হৃদয়ে নিজের মানুষটিকে আগের মত ‘জামাইবন্ধু’ হিসেবে পাবার সুপ্ত বাসনা। এক ভাস্কর নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে এক অন্ধবধুর ভাস্কর্য বানাবে বলেছে। কিন্তু অন্ধবধু ভাস্করের মুর্তিটিকে চায়। ভাস্কর তার নিজের মুর্তি বানিয়ে বধুকে দিক। সেই পাথরে হাত রেখে – ছুঁয়ে ছুঁয়ে এক ভাস্কর্য নিজের ভাস্করকে অনুভব করবে… কিন্তু ভাস্কর তো আর ভাস্কর্যের হৃদয় বুঝে চলে না! অন্ধবধুর মন থাকতে নেই। তাই শিহাবও কি পারুলের মনের দরোজার বাইরে থাকতে চায়?
তিলোত্তমা এই মহানগরের বুক চিরে এক অন্ধবধুর আর্তনাদ আরো হাজারো শব্দের সাথে মিশে থাকে। ‘আমি একবার তোমাকে নিজের মত করে অনুভব করতে চাই’ – এক অন্ধ বধুর এই নিরব আকুতি কখনো কি ওর প্রিয় চক্ষুস্মান মানুষটির হৃদয়ে পৌঁছাবে?
‘মনে কর যদি সব ছেড়ে হায়
চলে যেতে হয় কখনো আমায়
মনে রবে কি…’ **
মন থাকলেও মৃত নগরে বসবাসকারী রোবট মানুষগুলোর অনুভূতি শেষ হয়ে আসছে। তাই হৃদয়বতী নারীদের প্রতি তাদের ফিরে আসাটাও এখন আর আগের মত বর্ণীল নয়। রঙগুলোকে এই শহরে এসেই হারায় প্রিয় মানুষগুলো। একজন অন্ধবধুর নীরবে চলে যেতে চাওয়াটিও তাই কারো চোখে বিশেষভাবে পড়ে না। জীবন এখানে এমনই… …।।
_______________________
#ভাস্কর_মামুনের_ছোটগল্প
* যতীন্দ্র মোহন বাগচির ‘অন্ধবধু’ কবিতার লাইন।
** চিত্রা সিং এর গাওয়া গানের কলি।
loading...
loading...
প্রিয় চরিত্র শিহাবকে এখানে পেয়ে আবারও আগ্রহী হয়ে উঠলাম মি. মামুন। গল্পে কবিতায় আপনার হাত যথেষ্ঠ শক্তিশালী। ধন্যবাদ এবং শুভ সকাল।
loading...
অনেক ধন্যাবাদ ভাইয়া।
সাংবাদিকিতায় এসে গল্পেরা হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন লেখা হয়ে উঠছে না।
ভালো থাকুন সবসময়।

loading...
জীবন বোধের অনন্য সম্মিলন। অসাধারণ হয়েছে প্রিয় গল্প দা।
loading...
গল্পটি পড়ে আপনার সুন্দর অনুভূতি জানানোর শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় রিয়াদি'
ভালো থাকুন।
loading...
মামুন ভাই কওয়া নাই বলা নাই হুট কইরা ঢাহার শহর ছাইরাদেখা না কইরাই চইলা গেলেন!
loading...
কোথায়ও যাইনি আমি। সাভারের ভাড়া বাসাতেই আছি এখনও।
আসুন একদিন।
loading...
* জীবনের প্রতিবিম্ব…


loading...
ধন্যবাদ প্রিয় দিলওয়ার হুসাইন ভাই।
শুভেচ্ছা…
loading...