মিথ
মিথ কি? কাকে বলে? সাধারণত দেশের বা বিদেশের কালজয়ী রূপকথা, পৌরাণিক গল্প বা লোককথাকেই আমরা মিথ বলে থাকি। তা ছাড়াও এমন সব গল্পকে মিথ বলা হয়, যা আগে মানুষের মুখে মুখে গান হিসেবে প্রচলিত ছিল। তাহলে মিথ আসলে কি? কোথা থেকে মিথের উৎপত্তি? “মিথ” কথাটার অর্থই বা কি?
“মিথ” কথাটি এসেছে গ্রীক শব্দ Mythos থেকে, যার অর্থ হল anything uttered by a word of mouth. অর্থাৎ মুখ হতে নির্গত বা উচ্চারিত কোন কিছু “শব্দ” বা “লোককথা” বা “সত্য ঘটনা”। এ থেকে বোঝা যায় যে মূলত মানুষের মুখে মুখেই এই মিথ অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তো। এটাও বোঝা যায় এর শেকড় আসলে ছিলো সত্যের মাঝেই। মিথ শব্দটি আরও একটি শব্দের সাথে জড়িত আর তা হলো মিও, যার অর্থ “শেখানো”, অথবা “গোপন রহস্যের সন্ধান দেওয়া”।
খ্রিস্টপূর্ব ৭ম বা ৮ম শতকের দিকে মহাকবি হোমার মিথ শব্দটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি “ইলিয়াড” লেখার সময় এই শব্দ ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে তিনি একটি সত্য তুলে ধরার চেষ্টা। এছাড়া দার্শনিক প্লেটো তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে mythos শব্দটি ব্যবহার করেছেন এমন কিছু বোঝাতে যা হয়তো বাস্তবিক সত্য নয় আবার পুরোপুরি অসত্যও নয়। মানুষ নিজে বাঁচার লক্ষে এবং নিজের কল্পনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে জন্ম দিয়েছে অসংখ্য মিথের। নিয়ানডার্থালরা সর্বপ্রথম আত্মার এক অলীক কল্পনা মানুষের মধ্যে রোপণ করেন। সেখান থেকেও মিথের শুরু বলা যায়। এইবার প্রশ্ন হল নিয়ানডার্থাল? বা কারা? মানব বিবর্তন বা মানুষের উৎপত্তি বলতে বিবর্তন এর মাধ্যমে অন্যান্য হোমিনিড এবং বনমানুষ থেকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভবকে বোঝায়।
“মানুষ” বা “হিউম্যান” শব্দটি দ্বারা এখানে প্রকৃতপক্ষে কেবল হোমোগণ এ অন্তর্ভুক্ত প্রাণীদেরকে বোঝানো হচ্ছে, তাছাড়া তখন অস্ট্রালোপিথেকাস নামে আরও এক প্রজাতিকেও ছিল। আনুমানিক ২৩ লক্ষ থেকে ২৪ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকাতে হোমো গণটি অস্ট্রালোপিথেকাস গণ থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল হোমো গণে অনেক প্রজাতিরই উদ্ভব ঘটেছিল যদিও একমাত্র মানুষ ছাড়া তাদের সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ধরণের বিলুপ্ত মানব প্রজাতিগুলোর মধ্যে রয়েছে হোমো ইরেক্টাস যারা এশিয়ায় বাস করতো এবং হোমো নিয়ানডার্থালেনসিস যারা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য জুুুড়ে ছড়িয়ে ছিল।
আরকায়িক হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভব ঘটেছিল আনুমানিক ৪০০,০০০ থেকে ২৫০,০০০ পূর্বের সময়কালের মধ্যে। আরকায়িক বলতে হোমো স্যাপিয়েন্স দের প্রাচীনতম সদস্যদের বোঝানো হয় যারা প্রজাতি গত দিক দিয়ে এক হলেও আধুনিক মানুষের চেয়ে কিছু ক্ষেত্রে পৃথক ছিল। নিয়ানডার্থালরা ছিলেন আধুনিক মানুষের প্রথম পূর্বপুরুষ, মানে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ। এঁদের অস্তিত্ব ছিল প্লাইস্টেসিন যুগে।প্লাইস্টেসিন হল ভূতাত্ত্বিক যুগের নাম। এর সময়কাল ছিল ২,৫৮৮,০০০ থেকে ১১,৭০০ বছর। ইউরোপ ও এশিয়ার কয়েকটি অঞ্চলে আনুমানিক ২ লক্ষ বছর আগে রাজত্ব করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওদের শরীর ছিল রোমশ। কিছুটা ঝুঁকে চলত। গড়ন শক্তপোক্ত। নিয়ানডার্থালরা পাথরের তৈরি অস্ত্রশস্ত্র বানাত। আর ছিল অসম্ভব বুদ্ধিমান। ৭ হাজার বছর আগে ওরা বেঁচে ছিল। আনুমানিক ৫০,০০০ বছর পূর্ব থেকে নিয়ানডার্থালদের সঙ্গে আফ্রিকার হাইডেলবার্গদের সরাসরি সংযোগ ঘটেছে। এর মধ্যে ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা দুটি প্রজাতি একই পূর্বপুরুষ তথা আর্কায়িক দের থেকে বিবর্তিত হয়েছি। সে হিসেবে তারা আমাদের খুব নিকট আত্মীয়।
আবার আসি মিথ প্রসঙ্গে, ঐতিহাসিক নানা ঘটনা ও চরিত্রের সাথে কল্পনার মিশেল মিথকে করেছে সমৃদ্ধ। তবে সময়ের সাথে সাথে এই ভাবনার বদল ঘটে। এক সময় আধুনিকতাবাদ এবং আর ওপরে উত্তরাধুনিকতাবাদে স্থান পায় এই মিথ। অনেক পৌরাণিক কাহিনীর আড়ালেই কিছু সত্য লুকিয়ে থাকে। লেভি ক্লদ স্ট্রস তার ‘স্ট্রাকচারাল এনথ্রপলজি ‘ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষের সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় মিথ মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছে। কল্পনা হল মানুষের মনের একটি মৌলিক প্রবণতা যার সূচনা দেখা যায় আদি যুগে। প্রাচীন ধর্ম ভিত্তিক ইতিহাসে মিথকে কেবল অদৃশ্য শক্তির বর্নণায়ই ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সময় মহাবিশ্বের সৃষ্টি, প্রাকৃতিক ঘটনা এবং প্রাণীর জন্ম – মৃত্যু রহস্যের ব্যাখ্যার সন্ধান করা হয়েছে।
এই ব্যাখ্যা নানা কল্পিত পৌরাণিক চরিত্র এবং ঘটনার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে যেখানে যুক্তির চেয়ে ধারণা ও বিশ্বাসই প্রাধান্য পেয়েছ। কিন্তু কালের বিবর্তনে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও দর্শনের উন্নতি ঘটতে থাকে। সত্য কি, তার ব্যাপারেই মানুষের ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে। ফলে সময়ের সাথে সাথে মিথের সংজ্ঞাও যায় বদলে। প্রথম দিকের বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা প্রচলিত মিথের সত্যতা এবং স্থায়িত্বকাল নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ থেকেই চলে আসে মিথের প্রতি সহজাত একটা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস।
এর প্রায় ৪০০ বছর পরে মিথ সীমিত হয়ে যায় রূপকথা, প্রতীকী গল্প এবং ফিকশন জাতীয় গল্পে। এখনো মিথকে আমরা দেখি এভাবেই- একটা গল্প যার সত্যতার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ৪০০ বছর পুরনো একটা গল্প যে আসলেই মিথ্যা না কি সত্যি- সেটাই বা প্রমাণ করা যাবে কিভাবে? এটাও তো হতেই পারে যে একটা সময়ে বিভিন্ন সত্য ঘটনা মানুষ মিথের মাধ্যমেই প্রকাশ করতো- এবং তা বিশ্বাসও মিথোলজিতে থাকা এমন কিছু ঘটনা সত্য প্রমাণিত হয়েছে যাকে মানুষ নিছকই রূপকথা মনে করতো।
(আগামী খণ্ডে সমাপ্য)
loading...
loading...
কোন লাইন কোট করার শিক্ষা আমার মধ্যে নেই। গড়গড় করে পড়ে নিলাম। পড়লাম আর ভাবলাম … ঈশ্বর কত জানা থেকে দূরে রেখেছেন আমাকে !! জেনে চলেছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ বন্ধু রিয়া রিয়া। দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষা থাকবে।
loading...
নিরস এই প্রবন্ধ ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু।
loading...
দিদি ভাই, জ্ঞানের কোন শেষ নেই জ্ঞানের চেষ্টা বৃথা তাই।
এও বিশ্বের কতি কিছুই আমরা জানিনা অথচ নিজেকে সর্ব জ্ঞানি মনে করি। সত্যিই আসলে মিথ মানে আমি জানতাম না বা এ কথা কোথা থেকে কেন এসেছে অবশ্যই তা অজানা ছিল। আমার পড়ালেখা জাহাজ, সাগর এইসব নিয়ে। কাজের সূত্রে পৃথিবীর নানা দেশে গিয়েছি বলে নানা জাতির সাথে মিশতে পেরেছি বলে অনেক কিছু জানার সুযোগ যেমন পেয়েছি তেমনি অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। আজ এ সম্পর্কে লিখেছেন বলে জানতে পারলাম।
ভালবাসা অবিরত।

loading...
আপনার জন্যও প্রণাম খালিদ দা।
loading...
আমি আরো ভাবলাম মিথগুলির ধারাবাহিক সংক্ষিপ্ত রুপ দেখতে পাবো।
loading...
সুযোগ পেলে কোন সময় শেয়ার করবো ছবি দা।
loading...
অপেক্ষায় রইলাম।
loading...
জ্ঞানগর্ভ রচনা
loading...
ধন্যবাদ শংকর দাদা।
loading...
অসাধারণ লাগল
loading...
ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...