পরিহাস

ভারত ছেড়ে ইংরেজদের চলে যাবার পর ঢাকিজোড়ার হান্নান সাহেব মোকিমপুরের এক মামার বন্ধু সিংগাইরের গনি মুন্সির বাইন্ডিং কারখানায় পেটে ভাতে কাজ শেখার জন্য একটা চাকরি পেয়েছিলেন। বছর দুয়েকের মধ্যে বেশ একজন ভাল বাইন্ডার হবার পর শুধু ভাবেন এন্ট্রান্স পাশ দিয়ে সারাজীবন এই বাইন্ডিং কারখানায় পরে থাকতে হবে? পাশের গ্রামের কুদ্দুস মিয়ার সাথে আলাপ করে জানতে পারল মন্ত্রি সাহেবের কাছে জানাতে পারলেই সরকারি চাকরি নিশ্চিত। যেমনি ভাবা অমনি কাজ। পরের সপ্তাহেই ঢাকায় নিজের পাশের সোনাকান্ত গ্রামের খাদ্য মন্ত্রির বাসায় গিয়ে আর্জি জানাতেই তার সুপারিশে সরকারি অফিসে কেরানিগিরির একটা চাকরি পেলেন।

সরকারি চাকরি হয়েছে। ৯টা ৫টা অফিস করতে হবে। কে ভাত রেধে দিবে, কে ঘর দরজা গুছিয়ে রাখবে ভেবে অস্থির। বিয়ে করে সংসারি হলেই সব ঝামেলা মিটে যায়। কিন্তু……………। গ্রাম সম্পর্কের এক চাচা ইয়ার আলির ঘটকালিতে সাটুরিয়া গ্রামের আরমান বেপারি নামে এক ব্যবসায়ীর মেয়েকে বিয়ে করে হান্নান সাহেব যেন ধন্য হয়ে গেলেন। হবেন নাইবা কেন? সারা জীবন বিধবা মায়ের অনেক কষ্টের চেষ্টায় স্কুলের গন্ডী পেরুনো হান্নান সাহেব এর চেয়ে বেশি আর কিইবা আশা করতে পারেন?
শ্যালক শালিকারা চাকুরে দুলাভাই পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। দুলাভাইও শ্যালক শালিকা বলতে অজ্ঞান। তাদের নিয়েই মেতে থাকেন, তাদের সমস্ত শখ আহ্লাদ সাধ্যমত মিটিয়ে দেন।

দিন যায় বছর যায় হান্নান সাহেবের ছেলে মেয়েরা বড় হয়। ছেলে ভাল রোজগার করে। ওদিকে দুলাভাইয়ের প্রশ্রয়ে শ্যালক হাবিবুল্লাহ বেশ খরচের হাত পাকিয়ে বসেছে। বাবার আয়ের চেয়ে তার খরচের হাত অনেক বড়। দুলাভাই শশুরের সাথে সাথে শ্যালকর হাত খরচের জোগান দেয়। গ্রামের স্কুলে ভাল পড়াশুনার সুযোগ নেই তাই মানিকগঞ্জে হোস্টেলে থেকে মানিকগঞ্জের স্কুলে পড়াশুনা করে। বাবাকে চিঠি লেখে ব্লটিং পেপার কিনতে ২০০ টাকা লাগবে আর মুর্খ বাবা তাই পাঠিয়ে দেয়। এভাবেই হাবিবুল্লাহ আয়ের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করা আয়ত্ব করে নেয়। তবে মাথা ভাল থাকায় স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ভাল চাকরিও জুটিয়ে নেয়। কিন্তু হলে কি হবে? স্বভাব যার …………………তার কি আর সীমিত বেতনের টাকায় চলে? তার যে প্রয়োজনের তালিকা বিশাল, সীমাহীন পাহার ছোয়া। কয়েক বছর পর অফিসের বড় কর্তা হবার সুযোগে অনেক টাকা কেমন করে যেন উধাও হয়ে যায়। তবে মনে হয় হাবিবুল্লাহ সাহেব কিছু জানেন না কিন্তু অফিস কি আর তা মেনে নেয়? মেনে নেয়নি। হাবিবুল্লাহ সাহেবকে ছাটাই করে দিলেন।

এখন হাবিবুল্লাহ সাহেব তার শ্বেত হাতির খরচ কোথায় পাবে? এসে উঠলেন দুলাভাই এবং বোনের কাধে। দুলাভাইকে তেল মাখিয়ে রাজী করালেন ভাগ্নে যখন বিদেশ থেকে টাকার পাহার না হোক অন্তত টাকার টিলাতো নিয়ে আসছে, আমাকে সেই টাকাগুলি দিলে একটা বানিজ্য করে ওই টাকা ফিরিয়ে দিব। বোনের ছেলে তখন মাত্র রোজগার শুরু করেছে। ভাগ্যক্রমেই হোক আর বাবার সারা জীবনের সততার গুণেই হোক ছেলে বেশ অনেক রোজগার করে এনে মায়ের হাতে তুলে দিল। ভাগ্নে আসার সাথে সাথেই তার মামা দুলাভাই আর বোনকে মনে করিয়ে দিল যে ভাগ্নে টাকা নিয়ে এসেছে এখন টাকাগুলি আমাকে দিয়ে দাও। মা বাবা ছেলের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে বর্তমানে শ্যালক এর হাতে তুলে দিলেন।
মামা ব্যবসা করে টাকা ফিরিয়ে দিবে, তবুও মনে একটা সংশয় থেকেই যায়। মামার যে স্বভাব তাতে কি এই টাকা কোনদিন ফিরিয়ে দিতে পারবে! মা বাবা ভেবেই নিয়েছিল ছেলে এমনি করেই সারা জীবন টাকার বস্তা এনে দিবে আর তারা সেই টাকা ভাইকে তুলে দিবে। কিন্তু ভাবলেই কি আর তাই হয়? হয়নি।

কয়েকবার এমনি করে টাকা দেয়ার পর ভাগ্নে বিদেশের ওই চাকরি বদলে দেশে একটা চাকরি পেল কিন্তু এখানে আগের মত টাকার বস্তা হয় না।
এভাবে অনেকদিন চলে গেল কিন্তু মামার ব্যবসাও আর হয়না ভাগ্নের টাকাও আর ফিরিয়ে দেয়া হয় না। ওদিকে আবার অফিসের তহবিল গরমিলের অপরাধে অফিসের দায়ের করা মামলা পরিচালনার খরচতো আছেই। কিন্তু মামলা চালিয়েও কোন লাভ হলো না, আদালতের রায়ে জেল হয়েই গেল। ব্যবসার নামে ভাগ্নের কাছ থেকে আনা টাকা দিয়ে মামলা চালানোর জন্য উকিলের ফি, ঢাকা ক্লাবের মদের বিল, তার নিজের ছেলেমেয়েদের স্কুল কলেজের খরচ মিটিয়েই একদিন ইহুজগত ছেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল ওপারে। যাবার আগে ভাগ্নের কাছ থেকে আনা টাকার কথা কাউকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেনি ফলে যা হবার তাই হলো ওই টাকার কথা স্ত্রী কিছুটা জানলেও সন্তানেরা কিছুই জানতে পারল না। মৃত্যুর পর স্ত্রী রহিমা বেগম জেনেশুনে একেবারে অস্বীকার করে ভাগ্নেকে তাড়িয়ে দিলেন। আর ছেলেমেয়েরা নিশ্চিন্তায় বাবার আনা পরের টাকায় পড়াশুনা করে ভাল স্বচ্ছল হয়ে গেল। সবার ব্যাংকেই কোটি কোটি টাকা জমা হচ্ছে কিন্তু ভাগ্নের ছেলেমেয়েরা টাকার অভাবে পড়াশুনায় তেমন আগাতে পারলনা।

এভাবে বেশ কিছুদিন যাবার পর বোন আর দুলাভাইও ওপারে চলে গেলেন। মামার অন্য ভাইয়েরা এই টাকা দেয়ার কথা জানলেও তার সন্তানেরা তার কথায় কান দিতে রাজী ন্য। ভাগ্নে যখন নিরুপায় হয়ে মামার সন্তানদেরকে জানাল তোমাদের বাবার রেখে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করা তোমাদের জন্য অতিব জরুরী কারণ আমি এখন নিরূপায় কিন্তু মায়ের প্ররোচনায় তারা সে টাকার কথা মানতে রাজী নয়।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-১০-২০১৮ | ১০:৪৫ |

    ইহাই ভাগ্য। ইহাই বিড়ম্বনা। ইহাই বাস্তবতা। ইহাই পরিহাস। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. মোঃ খালিদ উমর : ১৯-১০-২০১৮ | ১১:৫০ |

    পরিহাসের হরেক রূপের ইহা মাত্র একটি রূপ। এমনি আরও বিবিধ রূপ রয়েছে যা ব্যাক্তি বিশেষে বিভিন্ন রূপ ধারন করে।

    GD Star Rating
    loading...
    • মুরুব্বী : ১৯-১০-২০১৮ | ১২:৩৪ |

      কিলোমিটারিয় লম্বা সহমত প্রিয় বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_mail.gif

      GD Star Rating
      loading...
      • মোঃ খালিদ উমর : ১৯-১০-২০১৮ | ১৪:২৭ |

        ধন্যবাদ বন্ধু। সহমত হতেই হবে, ইহা যে ধ্রুব সত্য।

        GD Star Rating
        loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৯-১০-২০১৮ | ১৯:১৫ |

    পড়লাম খালিদ ভাই। আসলে জীবন শব্দটাই জটিল। কেমন আছেন ?

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৯-১০-২০১৮ | ২০:৪৬ |

      ভালই আছি দাদা। আপনারা কেমন কাটালেন এই বীজয়া দশমী?

      GD Star Rating
      loading...
  4. রিয়া রিয়া : ১৯-১০-২০১৮ | ২০:৩৪ |

    চারিদিকে পরিহাস বৈ কিছু তো দেখি না খালিদ দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • মোঃ খালিদ উমর : ১৯-১০-২০১৮ | ২০:৪৮ |

      আসলেই চারিদিকে পরিহাস বৈ আর কিছুই নেই, সবই শূণ্য!  আজকের দিনটা কেমন কাটল দিদিভাই?

      GD Star Rating
      loading...
  5. মিড ডে ডেজারট : ১৯-১০-২০১৮ | ২২:২১ |

    আপনার লেখা গল্পগুলিতে প্রাণ থাকে; মনে হয় নিজ চোখে দেখে বর্ণনা করেছেন। তাই পড়তে ভালো লাগে। লেখায় অযথা মেদ থাকেনা।

    জীবনের গল্প।  

    GD Star Rating
    loading...