শেষ পর্যন্ত সত্য প্রকাশ হচ্ছে। মিয়ানমারের কয়েকজন জেনারেলের সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দাবি উঠেছে। কী নারকীয় গণহত্যা হয়েছে মিয়ানমারে! মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যায় ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় মিয়ানমার সেনা কর্মকর্তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে সেনাবাহিনীর সরাসরি সংশ্লিষ্টতা ও দায়-দায়িত্বের কথা তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীকেই এ গণহত্যার দায় নিতে হবে। সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেশটির বেসামরিক নেতৃত্বও এই নিধনযজ্ঞে ইন্ধন জুগিয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর তথা সরকারপ্রধান অং সান সু চি তার সাংবিধানিক ও আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। রাখাইনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকারের মাত্রায় তারা অবাক হয়েছেন। জাতিসংঘ এ প্রতিবেদনটি তৈরি করতে শত শত ব্যক্তির সাক্ষাতকার নিয়েছে। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের তরফ থেকে এটাই মিয়ানমারের সংঘটিত নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কড়া হুঁশিয়ারি ও নিন্দা। ইন্দোনেশিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব মারজুকি দারুসম্যান এ ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কমিশনের সদস্য ছিলেন শ্রীলঙ্কার রাধিকা কুমারাস্বামী ও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টোফার সিদোতি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন মিশনকে সার্বিকভাবে সহায়তা দেয়।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি-কে আমরা চিনি। আমরা তার অতীত জানি। তিনি নোবেল পেয়েছিলেন ও কেন তিনি পেয়েছিলেন এই পদক? কারণগুলোও জানানো হয়েছিল তখন।
১৯৯১ সালে অং সান সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে নোবেল কমিটির প্রেস রিলিজে বলা হয়েছিল, ‘নরওয়ের নোবেল কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার অং সান সু চিকে দেওয়া হবে। এটি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য তার অহিংস সংগ্রামের জন্য দেওয়া হচ্ছে। তিনি নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজন আদর্শ হিসেবে পরিণত হয়েছেন। ১৯৯১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার পাশাপাশি নোবেল কমিটি অং সান সু চি-কে সম্মান জানাতে চায় বিশ্বের বহু মানুষের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মানবাধিকার ও জাতিগত শান্তি বজায় রাখায় তার শান্তিপূর্ণ সমর্থন ও অবিরত প্রচেষ্টার জন্য।’
প্রিয় পাঠক, এটা হলো ঘোষণাপত্র। কিন্তু বাস্তবে কি দেখছি আমরা? বড় ভয়াবহ আজকের মিয়ানমার। কেন নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে? এটা কেমন অমানবিকতা? কেউ কিছু বলছেন না কেন? জাতিসংঘের সংবিধান কি বলছে? আমাদের মনে আছে, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে বন্দি শিবির ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। তা নিয়ে কি কোনো তল্লাশি করেছিল বিশ্বসম্প্রদায়? না- করেনি। খবর বেরিয়েছিল, মায়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নির্যাতন করে দেশ থেকে জোরপূর্বক সাগরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করছে দেশটির ক্ষমতাসীনরা। তারপরও বিশ্বের মানবতাবাদী নেতারা পালন করছেন এক ধরনের নীরবতা। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, বর্তমান মায়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভ‚গোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি স¤প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস।
২০১২ সালে, ২০১৬ সালেও একবার এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর হামলে পড়েছিল খুনিরা। কিছুদিন পরে তা কিছুটা স্তিমিত হলেও রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ চলছেই নীরবে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক কথা হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় গোত্র দাবি করেন। অথচ সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জাতির দেশ মায়ানমারে গণহত্যা চলছে। তারা ভুলে গেছে মহামতি বুদ্ধের অমর বাণী- প্রাণী হত্যা মহাপাপ। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সীমান্ত খুলে দেয়ার এবং অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মানবিক বিবেচনায় সীমান্ত খুলে দেয়ার কথা বললেও বাংলাদেশ মনে করে, মানবতার দায় বাংলাদেশের একার নয়। কথাটা বাংলাদেশের সরকার ঠিকই বলছে। কারণ মায়ানমারে কোনো যুদ্ধ চলছে না। একটি গোষ্ঠী অন্য একটি গোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। বিশ্বেও প্রভাবশালীরা কেন মায়ানমারের শাসকচক্রকে ডেকে তা জিজ্ঞাসা করছেন না? বিশ্ব সম্প্রদায়েরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে দায় রয়েছে। তাদের উচিত, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী সমাধানে এগিয়ে আসা।
মনে আছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তল্লাশিচৌকিতে হামলার জের ধরে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘাতে সেখানকার মানবিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। বাংলাদেশে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা এখনও রয়ে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে সেখানকার বেসামরিক লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে এখনই সময় এসেছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিষয়টি নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে বিভিন্ন দেশ ও জোট। এই সেপ্টেম্বরেই জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে আসছেন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের পরিস্থিতি আলোচ্যসূচিতে রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ ছাড়া তুরস্কসহ ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) বেশ কয়েকটি দেশও বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে যুক্ত করতে চাইছে। দুই সপ্তাহ পর অধিবেশন শুরুর আগের সময়টাতে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে রাখাইনে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার জন্য মিয়ানমারকে আহবান জানাতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
অন্য যে মারাত্মক বিষয়টি সবার নজর কাড়ছে তা হলো- মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু মৌলবাদী-জঙ্গি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যে জঙ্গি গ্রুপ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার মদদ দিচ্ছে। ইতিহাস বলছে, ১৯৭৮ সালে এরকম এক হামলার পর প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এরা এখনো বাংলাদেশেই আছে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিহারিরা বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিল- এদের প্রজন্মের সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি বলে বলা হচ্ছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে অর্থ পাওনা দাবি করেছে স¤প্রতি। কিন্তু তারা তাদের ওই বিহারিদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা একবারও বলেনি গেল ৪৫ বছরে।
ফিরে আসি রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে। আগেই জানানো হয়েছে মায়ানমারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় সম্পর্কিত একটি কমিশন গঠন করবে দেশটির সরকার। আমরা জানি না কফি আনান কমিশনের সর্বশেষ অগ্রগতি কি! এই কমিশন মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা ও তাদের ঘিরে দেশটিতে যে সংকট রয়েছে তার সমাধান খোঁজার জন্য কাজ করছিল। তবে, নতুন এই কমিশন রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে চলমান সংকট নিয়েও কাজ করবে কিনা সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। জাতিসংঘের ভাষায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষজন বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটি। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাস, যারা পৃথিবীর কোনো দেশের নাগরিক নয়। দেশটি রোহিঙ্গাদের তার নাগরিক মনে করে না। বরং মিয়ানমার মনে করে তাদের আদি আবাস বাংলাদেশ। এমনকি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারেও দেশটির সরকারের আপত্তি রয়েছে। এসব বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়া দরকার।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সাং সুচি বহুদিন যাবৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করেননি। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এই নেত্রী রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে কথা বলবেন সেটাই বিশ্ব প্রত্যাশা করেছিল। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি চাইলে এই সমস্যার জোর সমাধান দরকার। সু চি কি তাহলে তার অবস্থানের পরিবর্তন করেছেন? কেন করেছেন? তিনি তো ‘শান্তির’ জন্যই নোবেল পেয়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-চীন-নেপাল-শ্রীলঙ্কার যৌথ আলোচনা দরকার। মায়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা দরকার, বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য। কারণ রক্তাক্ত সহিংসতা আরো রক্তপাতের জন্ম দেয়। যা প্রতিবেশী দেশের শান্তি খুব সহজেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। সুচি, মানুষের রক্ত নিয়ে খেলছেন। এর পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে। মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে। যা সংকট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ হওয়া দরকার। এই তীব্র আর্তনাদের সমাপ্তি দরকার।
___________________
ফকির ইলিয়াস: কলামিস্ট।
প্রথম প্রকাশ : এখানে।
loading...
loading...
'সুচি, মানুষের রক্ত নিয়ে খেলছেন। এর পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে। মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে। যা সংকট কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ হওয়া দরকার। এই তীব্র আর্তনাদের সমাপ্তি দরকার।'
loading...
মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু মৌলবাদী-জঙ্গি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। যে জঙ্গি গ্রুপ উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে, বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানার মদদ দিচ্ছে। কথা সত্য দাদা।
loading...
* সকল সাম্প্রদায়িকতার অবসান হোক। মুক্তি পাক মানবতা…
loading...