প্রচণ্ড বরষায় ভিজে ভিজে সাইডব্যাগটিকে সামলে যখন বাসটির নির্ধারিত আসনে বসে শিহাব, বামপাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো পাশের সহযাত্রী বৃষ্টিবিলাসী মনে গভীর তন্ময়তায় মৌণ-বিভোর! পাশে কারো উপস্থিতিতে ঘোর থেকে জেগে ওঠে নারী.. হাজার বছরের রহস্যময়ী কালের সোপান বেয়ে ধেয়ে আসা দৃষ্টির ছুঁয়ে যাওয়ায় নিঃশ্চুপ শিহাব.. থমকে যাওয়া সময়ের দ্বিতীয় যাত্রী হয়ে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে অধর কোণের সেই তিলটির দিকে!
এ-টু সিটে বসে সামনের উইন্ডস্ক্রিণ দিয়ে মেঘবালিকাদের অবিরাম কান্না দেখে দেখে নিজের মনে হাসে শিহাব.. না, সে না! তার তিল ছিলো দুইটি। একটি বড়, অন্যটি বাবু তিল। অধর কোণে না… অন্য এক জায়গায়। তিলোত্তমা সেই বালিকা.. শিহাবের হারানো সুর! এতগুলো বছর পরে.. এভাবে সামান্য একটি ভুল জায়গার তিল বালিকাকে মনে করিয়ে দিলো?
তিল! সামান্য?
আহ! বালিকা.. এখনো মনে পড়াও, জ্বালা ধরায়। পুড়ে যায়.. এ হৃদয়। দম বন্ধ হয়ে খাবি খায়.. নিঃসংগতার নিঝুম নিমগ্নতায়।
ওহ! বালিকা.. তুমি কোথায়?
দুই পাশে এ্যাকাশিয়া গাছের টানেলের মাঝ দিয়ে সতর্ক ড্রাইভার কালো পিচের রাস্তা দিয়ে সামনে আগায়।
…
শিহাবের স্রষ্টা ওকে নিয়ে অনেক খেলা খেলেছেন। শিহাব কেন সেই খেলায় অংশ নিলো কিংবা নিতে বাধ্য হলো- সেসব আরেক প্রসংগ। সেদিকে যাবার কিংবা সেসব জানার প্রয়োজন দেখি না।
তবে একদিন ঘুম থেকে উঠে শিহাব দেখে, তার মাথার চুল অধিকাংশই সাদা। পার হয়ে গেছে বউয়ের সাথে হেলা খেলায় এক কুড়ি বছর। দুইটা বাবু নিজেদের মত বড় হচ্ছে… বউয়ের গৃহিনী অবয়বের মাঝে নেই সেই অচেনা প্রথম ফুলশয্যা রাতের মেয়েটি। সময় মেয়েটিকে পূর্ণ রমনীর বাইরের শেষ ধাপে নিয়ে গেছে। এখন শরীর শরীর খেলার ভিতরে নিরুত্তাপ আবেগ। হৃদয়ের সেই গলে যাওয়া অনুভব রুদ্ধ হয়ে এখন আর অনুভূতি আনে না। এখন মনের টানে শরীর আসে না। কিংবা শরীরের টানে মন। এখন কেবলি যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের মিলন.. যেখানে সুদূর প্রবাসী মন।
এই যখন শিহাবের বর্তমান জীবন, হঠাত একদিন অন্যরকম কিছু ঘটলো। জোর করে টেনে চলা জীবনের কোনো এক ফাক গলে মন সমেত এক দেহধারী নারীর আগমন। ত্রিশংকু অবস্থায় শিহাব। ধুর, যা হয় হোক না। নিজেকে জীবনের অপভ্রংশ স্তরের ভিতরে ঠেলে দিয়ে, অন্ধকার গহবরের একচিলতে কালো আলোয় নিজেকে দেখবার চেষ্টা করে শিহাব।
সেই নারী ভার্চুয়ালি রাতের পর রাত.. দিনের শুরু কিংবা মধ্য প্রহর পার হয়ে কখনো পিদিম জ্বলা সাঁঝের বেলা, নিরবে অনুভবের ভিতর অনুভূতি শেয়ারের চেষ্টা চালায়। শিহাব এর কোনোটিই নেয় না। আবার লোভও সামলাতে পারে না। পুরুষের ইন্দ্রিয় সুখের তীব্রতর প্রক্ষেপণ বেশ কয়েক দশক আগেই থিতু হতে শুরু করেছে। এই নারী সেই ছাইচাপা আগুনকে উস্কে দিয়ে দাবানল সৃষ্টিতে রত। বেশ বুঝে শিহাব।
একদিন মধ্যরাতে এলোমেলো শিহাব। বউয়ের থেকে অনেক দূরে। প্রায় পক্ষকাল। বউয়ের পাশে ঘুমানোর অভ্যস্ততার সাময়িক অনভ্যস্ততার সুযোগ পেয়ে উথলে ওঠা তীব্র শারিরীক চাহিদা, তীব্র সাইনাস পেইনের মতো যন্ত্রণাকর হয়ে ওঠে। সামনে আসে সেই নারী। পরনারী। যাকে শাস্ত্রে পরিত্যাজ্য ঘোষনা করা হয়েছে।
কে করেছে? শিহাব নিজের কাছে জানতে চায়, ‘তুমি কি করেছ?’ মন নেতিবাচক উত্তর দিলে আগুন জ্বলে ফাগুনের মোহনায়। দুই নদী এক হতে চায় এক বিষণ্ণ মধ্য রাতে।
দূরে থেকে অনুভবের মাঝে অনুভূতির ছুয়ে দেবার এক অস্বাভাবিক প্রেম প্রেম খেলায়, নারী নিজেকে দেখায়.. কাছে টানায়, কিন্তু দূরেই রয়। সে অসম্পূর্ণ সমর্পণ করে শিহাবের কাছে। শিহাব এলোমেলো.. সম্পূর্ণ দেখতে চায় নারীকে ভার্চুয়ালি।
নারী তিনটি ছবিতে নিজেকে দেখায়।
প্রথম ছবিতে বিছানায় বসা নারী। স্বচ্ছ নেটের মশারির ভিতরে ল্যাপটপে কাজ করছে এক অচেনা মধ্যবয়সী পুরুষ। ক্যামেরার দিকে তার পিঠ। নারী নিজের সংক্ষিপ্ত ঘুমানোর পোশাকে ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছে। গলার কাছটায় অনেকটা উন্মুক্ত!
প্রথম ধাক্কা খায় শিহাব। হারানো সুর গুনগুন করে বিস্মৃতির অতল গহবর থেকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিতে চায়! তিল!
দ্বিতীয় ছবিতে বিছানায় শুয়ে আছে নারী। একা। পাশের পুরুষের অংশবিশেষ ছায়ার মতো দেখা যায়। নারীর মাথার চুল এলোমেলো। চোখে আগুন জ্বলে উঠে নিভে গিয়ে তৃপ্তির চকমকে আভা! শারিরীক চাহিদা শেষে নিজের বিছানায় বউয়ের চোখে এই একই চকমকে উজ্জ্বলতায় অনেক অনেক বার চোখ ধাঁধিয়ে গেছে শিহাবের! রমন শেষে পরিতৃপ্ত রমনী শিহাবকে লণ্ডভণ্ড বিছানায় নিজের পুরুষের কায়াহীন ছায়ার পাশে শুয়ে থেকে দ্বিতীয় ছবিটি পাঠায়। বড় তিলটি গলার সেই নির্দিষ্ট জায়গাটিতেই একই রকম দৃশ্যমান!
হ্যা! ত্রিশ বছর পরে সেই হারানো বালিকা পূর্ণ রমনী হয়ে আজ নিজেকে শিহাবের সামনে এক আয়তাকার ভার্চুয়াল জীবনের অপর পারে এক ভিন্ন পুরুষের বিছানায় শুয়ে থেকে নিজেকে দেখায়! ভিন্ন পুরুষটি এখন সেই একদার বালিকার নিজের পুরুষ।
তৃতীয় ছবি! দুইটি তিল সহ সেই নারীর বালিকা হবার অপপ্রয়াস! যেভাবে কোনো একসময় তিলে তিলে ছুয়ে ছুয়ে বালিকার ভিতরের নারীর অনুভবে অনুভূতি জাগানোর চেষ্টা করতো শিহাব! সেই একই ভংগীমা.. একই হাসি.. মদির চোখের একইভাবে জ্বলে ওঠা, অত:পর মিইয়ে যাওয়া.. আবার জ্বলা.. নিভা.. এভাবে বারবার… হ্যা! সে সেই মেয়েটিই।
সময় যাকে নারীতে পরিণত করেছে। কিন্তু স্বভাবে সে একই সেই বালিকাই রয়ে গেছে। ত্রিশ বছরের যন্ত্রণা আবার নতুন করে শিহাবকে পেয়ে বসে, নতুনভাবে কষ্টকর সেই সময়ের তীব্রতায় ক্ষয়ে যেতে থাকে শিহাব। গলে যায় যন্ত্রনায়। বুকের কোথায় যেন চিনচন করে। এখন আর শারিরীক চাহিদা অনুভব করে না। বালিকার দুইটি তিল সময়ের পথ পরিভ্রমণ শেষে এক নারীর বুকের গোপন বিউটি স্পটে পরিণত হয়েছে- যার শরীরটা কিছুক্ষণ আগেও ভীষণভাবে দুমরে মুচরে দলিত মথিত করে ছিড়ে খুবলে একাকার করে দিতে চেয়েছিলো শিহাব। কিন্তু প্রথম প্রেমের সেই বালিকা সামনে আসায় কোথায় হারালো সেই উন্মত্ততা? অসুরতা?
তৃতীয় ছবিতে বুক খোলা নারীর বুকের উপর তার পুরুষের ঘুমন্ত অবহেলায় পড়ে থাকা একটি হাত নেটের মশারির বাইরে থেকেও দেখা যায়। নারী চেয়ে আছে শিহাবের দিকে.. একটা ছবিই তো.. কিন্তু শিহাবের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা দুটি চোখ, খোলা বুক আর নিঃসংগ এক জোড়া কালো তিল- শিহাবকে কাছে টানতে চায়! শিহাব শীতল থেকে শীতলতর.. ক্রমশঃ আরো অধিক শীতলতম প্রদেশের একমাত্র বাসিন্দা হয়ে যায়।
মৃত্যুর ওপার থেকে জীবনের ডাক শুনতে পায় শিহাব! বালিকা ত্রিশ বছর আগেও তার সাথে শরীর শরীর খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিল। যা শেষ হয়নি, এর আগেই…
আজ ত্রিশ বছর পরেও সেই একই বালিকা নিজের পুরুষটির পাশে থেকেও ভার্চুয়ালি আরেক অন্য পুরুষের অনুভবে অনুভূতি ঢেলে দেবার চেষ্টারত!
হায় বালিকা!
নিজের সাময়িক পথভ্রষ্টতায় নিজের থেকে দূরে সরে যাওয়ায় শিহাব দূর থেকে আবার নিজের কাছে আসার চেষ্টা করে। ফিরে আসার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। পদস্খলন অনুভবেই এলেই আবার নতুনভাবে শুধরে নেবার সময় থেকেই যায়।
নিজের বউকে বড্ড মনে পড়ে হঠাত। বউয়ের পরিচিত শরীরের ঘ্রাণ পায় অনুভবে-কল্পনায়! এক গভীর রাতে বালিকা এবং বালিকার নারীরুপ- উভয়ের প্রেম প্রেম খেলায় ভালোবাসা ছিলনা এটা বড্ড প্রকটভাবে অনুভবে আসে আজ শিহাবের। বাতাসে বউয়ের ঘ্রাণ.. নিজের শরীর ছাপিয়েও বউয়ের এক কুড়ি বছর পাশে থাকার ঘ্রাণ! মোবাইলের বহু পরিচিত নাম্বারটি আংগুল নিজেই প্রেস করে যেতে থাকে… দীর্ঘদিন পরে যান্ত্রিক শরীর ছাপিয়ে নিজের মনকে আবিষ্কার করে শিহাব। বুক ধুকধুক করে, প্রথম রাতের উত্তেজনায় দৃঢ় হয়ে ওঠে শিহাবের ভিতরের শিহাব।
ঘুমজড়ানো কন্ঠে বউয়ের অসাধারণ কণ্ঠস্বর আরো এ্যাপিল এনে দেয় শিহাবকে.. ফুলশয্যার সেই রাতটিতে ফিরে যায় শিহাব।
– হ্যালো
বউয়ের আওয়াজ আজ কেন জানি আরো মধুর লাগে। উত্তেজনায় কম্পিত স্বরে শিহাব বলে,
– এ্যাই! কাছে আসো!
– এত রাতে ঘুম ভাংগায়ে ঢং করতে আসছে
একথা বলেই বউ ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
মৃদু হেসে শিহাব ব্যালকনিতে এসে রাতের শেষ সিগ্রেটটি জ্বালায়। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আরো বেগবান হয়েছে। অন্ধকারে দূর থেকে জ্বলন্ত সিগ্রেটের আগুনকে ম্লান করে তোলে শিহাবের জ্বলতে থাকা দুই চোখ। সেখানে আজ পূর্ণরুপে ভালোবাসার চমক জমেছে।
হৃদয়ে ভালোবাসা জন্ম নিতে সময় লাগে না। ত্রিশ বছর কেনো, এক কোটি বছর প্রয়োজনে অপেক্ষা করুন, ভালোবাসার জন্ম হবেই। আর একজীবনে যদি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের সাথে একটি রাতও কাটাতে না পারেন, সেই জীবন মূল্যহীন।
ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকুন… ভালো থাকবেন।।
______________________________________
#তুমি_এক_জোড়া_তিল_এবং_তিনটি_ছবি_অণুগল্প_৪৪২
loading...
loading...
লিখাটির পাদটীকায় এসে গল্পকার হিসের দারুণ একটি বার্তা দিয়েছেন মি. মামুন।

loading...
শুভেচ্ছা নিন গল্প দা। গল্পের জন্য প্রচ্ছদটার প্রয়োজন ছিল।
loading...
মামুন ভাই, অনেক অনেকদিন যাবত no যোগাযোগ।
তবে আপনার আনাগোনা, পরিবর্তন সবই লক্ষ করছি।
ভাল থাকুন অনন্ত কাল।
loading...
* একটা অসাধারণ গল্প পড়লাম…
শুভরাত্রি মামুন ভাই।
loading...
"আর একজীবনে যদি সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষের সাথে একটি রাতও কাটাতে না পারেন, সেই জীবন মূল্যহীন"
loading...