মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা-ত্রিশ লাখ উপাখ্যান

‘রিপোর্ট ১৯৭১’ নামে কবি আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতা আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন,

‘জনাব উথান্ট,
জাতিসংঘ ভবনের মেরামত অনিবার্য আজ।
আমাকে দেবেন, গুরু, দয়া করে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান
পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে একমাত্র আমি দিতে পারি
যদি চান শিশু ও গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আল্পনা
প্লিজ, আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন।
দশ লক্ষ মৃতদেহ থেকে
দুর্গন্ধের দুর্বোধ্য জবান শিখে রিপোর্ট লিখেছি—পড়, পাঠ কর।’

কবিতাটি কবি লিখেছেন ১৯৭১ সালে। জুন-জুলাই পর্যন্ত শহিদের সংখ্যা ৭-১০ লাখ হলেও ক্রমান্বয়ে সেটি বাড়তে থাকে। ইদানীং মাঝেমাঝেই কাউকে কাউকে বলতে শুনি, বঙ্গবন্ধু নাকি ডেভিড ফস্টারকে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা “আমার তিন মিলিয়ন মানুষকে” হত্যা করেছে। তিনি “লাখ”কে “মিলিয়নের” সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিলেন এমন একটি কথা যারা বলেন, এই লেখাটি তাদের কিছুটা বোধোদয় করবে বলে আমি মনে করি।
প্রথমেই সংবাদপত্রের রিপোর্ট দেখব আমরা। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে ত্রিশ লাখ শহিদের কথা এসেছে। দৈনিক পূর্বদেশ-এর সম্পাদক তার পত্রিকায় ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ‘ইয়াইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। সেখানে পরিষ্কার করে লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দুই শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে’। এরপর রাশিয়ার প্রাভদা, ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে ত্রিশ লাখের কথা উল্লেখ করে। ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি মর্নিং নিউজ-এ ত্রিশ লাখের কথাই আবার উল্লেখ করা হয়। ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করেছিল এভাবে, ‘পাক আর্মি কিল্ড ওভার ৩০ লাখ পিউপল’, যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি। ১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকা ‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করে। সেখানে ত্রিশ লাখ শহিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় পত্রিকাটি।

এবার দেখব ১৯৭১ সালে বিদেশি সংবাদপত্রগুলো হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে কী ধারণা দেয়। যদিও সাংবাদিকদের অনেককেই বের করে দেওয়া হয় ২৫ মার্চ রাতে। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ-এর ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সংখ্যাটা পড়লে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করে বের করে দেওয়ার ঘটনাটি। ওই রিপোর্ট থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি,
‘স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধূলিসাত্ করতে সেনাবাহিনী যখন অভিযানে নামে সেই সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সকল বিদেশি সাংবাদিককে অস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং পরে সবাইকে ধরে প্লেনে উঠিয়ে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং হোটেলের ছাদে লুকিয়ে থেকে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন; যদিও তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালানো হয়েছে। সাইমন ড্রিং ছাড়া কেবল অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাইমন ড্রিং জ্বলন্ত ঢাকা শহরে ব্যাপকভাবে ঘুরে দেখার সুযোগ পান। গতকাল একটি প্লেনে করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আসতে সক্ষম হন। দু দুবার তার বস্ত্র উন্মোচন করে তল্লাশি চালানো এবং তার লাগেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও, কৌশলে তিনি ঢাকায় নেওয়া নোটগুলোসহ সোমবার সকালে ব্যাংকক পৌঁছে এই রিপোর্ট পাঠান’ (দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, ২৭ মার্চ ১৯৭১)

সেসময় এতো কিছুর পরও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। এর কয়েকটি উল্লেখ করছি-
• টাইমস, একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে, মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে।
• নিউজউইক, এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লিখেছে, নিহতের সংখ্যা সাত লাখ।
• দ্য মোমেন্টো, কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ।
• ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ২৩ জুলাইয়ে রিপোর্ট করেছে সংখ্যাটা ১০ লাখ।
• টাইমস, সেপ্টেম্বরে বলেছে নিহতের সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক।
• দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস, লন্ডন (১ অক্টোবর) বলেছে শহিদের সংখ্যা ২০ লাখ।
• ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে লিখেছে শহিদের সংখ্যা ৩০ লাখ।
স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলেই বোঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে এপ্রিলে সাত লাখ, জুলাইতে দশ লাখ, সেপ্টেম্বরে বিশ লাখ। তাহলে ডিসেম্বরে তিরিশ লাখ শহিদ আকাশ থেকে আসা ফিগার মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। এবার মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কী বলে তা দেখব। যেখানে গণহত্যার পর হতাহতের সংখ্যা বের করার গাণিতিক সূত্র মেনে মৃত মানুষের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হওয়া অনেকগুলো গবেষণা থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি-
• ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. টেড রবার্ট গার এবং ইউএস নেভি একাডেমিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. বারবারা হার্ফ তাদের বিখ্যাত গবেষণা, যেটা পরবর্তী সময়ে পুস্তক হিসেবেও প্রকাশিত হয়, টুয়ার্ড অ্যাম্পিরিক্যাল থিওরি অব জেনোসাইডস অ্যান্ড পলিটিসাইডস -এ উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ১২,৫০,০০০ থেকে ৩০,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে। (এটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে)
• কম্পটনস এনসাইক্লোপিডিয়া তাদের গণহত্যা পরিচ্ছদে মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা লিখেছে ৩০ লাখ।
• এনসাইক্লোপিডিয়া অ্যামেরিকানা বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে নিহত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ত্রিশ লাখ।
• গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তার বিখ্যাত জেনোসাইড বইতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছে।
• পুলিতজার পুরস্কার বিজয়ী আ প্রোবলেম ফ্রম হেল: অ্যামেরিকা অ্যান্ড দ্য এইজ অব জেনোসাইড গ্রন্থের লেখিকা সামান্তা পাওয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন গণহত্যার খতিয়ান বের করেছেন। বেস্ট সেলার এই বইটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় ৩০ লাখ পর্যন্ত।

১৯৭১ সালে শুধু বাংলাদেশে অবস্থান করা মানুষ মরেনি। বিভিন্ন ডাটা অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষের সংখ্যা কম করে হলেও ৬ থেকে ১২ লাখ। তবে এদের শহিদের মর্যাদা দেওয়া হোক বা না হোক, কিন্তু এদের মৃত্যুর কারণ সেই একটাই— পাকিস্তান।
মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা কত- এই প্রশ্নে যারা ৩০ লাখ মানুষের শহিদ হওয়াটা একান্তই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মস্তিষ্কপ্রসূত বলে মনে করেন, যারা ভাবেন আসল সংখ্যাটা তিন লাখ; তাদের জানা উচিত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে এই তিন লাখ ফিগারটি কোথা থেকে এল। বঙ্গবন্ধুর আগে কি কেউ এই সংখ্যা উচ্চারণ করেছেন? ত্রিশ লাখ আগে এসেছে নাকি তিন লাখ? আসলে পরে এই তিন লাখ ফিগার যারা কল্পনা করেন, তারা এদেশের কেউ নন; তারা পাকিস্তানের দালাল। আমি মনে করি, যেকোনো উৎস থেকে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাদবাকি প্যারামিটারে সর্বোচ্চ মানগুলো গ্রহণ করলে, মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ত্রিশ লাখের চেয়ে বেশি হবে; কম নয়।

(ছবি- listupon.com, Wikipedia, Herald Magazine – Dawn)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. সাইদুর রহমান১ : ০৯-০৭-২০১৮ | ১:৫১ |

    ইতিহাসের দারুন আয়োজন। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ০৯-০৭-২০১৮ | ৬:৩৭ |

    প্রথমেই জানিয়ে দিই শব্দনীড় এ আপনাকে স্বাগতম এবং শুভ সকাল।

    মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে পর্যালোচনা পড়লাম। নিশ্চিত যে এই সংখ্যা একটি ফ্যাক্টর বটে। ইতিহাসের কালিতে সত্যকে সত্য হিসেবেই ধরে রাখা উচিত। মিথ্যের অথবা অনুমানের জায়গা ইতিহাস নয়। বহুকাল জুড়ে থাকা অথবা ঔষধের ডোজ হিসেবে জাতিকে সত্য থেকে ঐচ্ছিক অ-সম্পৃক্ত করে রাখা এটাও ইতিহাস একসময় অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে। আমি সাধারণ অরাজনৈতিক মানুষ; কিন্তু সময়ের স্বাক্ষীও বটে।

    youtube.com/watch?v=G-lDacV5je4

     

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৩:২১ |

    সত্য ইতিহাস বহন করে চলুক বাংলাদেশ। শব্দনীড়ে স্বাগতম দাদা।

    GD Star Rating
    loading...
  4. রুকশানা হক : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৩:২৭ |

    মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে অমূলক বিতর্ক সৃষ্টি করে এই মহতী যূদ্ধকে কলুষিত না করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানাই।

    GD Star Rating
    loading...
  5. চারু মান্নান : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৪:০৭ |

    আমার্ও তাই মনে হয় ত্রীশ লাখের বেশী হবে, কম হবে না 

    কারন সেই সময় হিসেব নিকেশ কসা খুবই জটিল কাজ ছিল,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

    পৃথিবী জোড়া মিডিয়া আমেরিকার পক্ষে ছিল,,,,,,,,,,,

    GD Star Rating
    loading...
  6. ইলহাম : ০৯-০৭-২০১৮ | ১৭:৩৮ |

    প্রিয় হাসান হামিদ ভাই, স্বাগতম শব্দনীড় এ।

    আপনার লেখাটি অনেকের  ভুল ধারণাকে সঠিক করতে সহায়ক হবে আমার বিশ্বাস।

    চলুক আপনার কলম অন্তহীন!!!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...