বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান … (১)
বিয়ের গানে জীবিকা … (২)
জাতি – ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাভাষী মানুষজনের অনেকেই এখনো মেয়েদের গৃহকর্মকে জীবিকা বলে মনে করেন। তো,সেকারনেই অল্প বয়েসে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মা-বাপ নিজেদের ঘাড়- মাথা হাল্কা করে নেন। অবশ্য এর পেছনে আরো অন্যান্য নানাবিধ পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতাও ক্রিয়াশীল থাকে। মা-বাপের সচেতনতার অভাব,তার চেয়েও বেশি নিরুপায়তা এখানে তাদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে নেয়। তারা বিলক্ষণ জানেন, বিবাহিত জীবন তাদের মেয়েকে কেমনভাবে কাটাতে হতে পারে :
উসারায় বসে বিটি চালো পাছুড়ছে
চালো পাছুড়তে বিটি একমুঠো চাল খেয়েছে
উসারায় ছেলো শাউড়িবিবি গালে ঠোনা মেরেছে
এগনেয় ছেলো ননদিনী হেতের ছুঁড়ে মেরেছে
ঘরকে ছেলো সতীন মাগি জামাইকে টিপনী দিয়েছে
জামাই ছেলো দলিজে বসি, চুলের মুঠি ধরেছে
জুড়া পাচন বালির পিঠে দাগড়া করি মেরেছে ——
ঘরের এতো আদর – কদর মেয়েটিকে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে ভাগ্যান্বেষণে প্ররোচিত করে। ঘরের বাইরে তার জন্য কি সমাদর অপেক্ষা করে আছে দেখুন :
অজয় নদী উলুথুলু আমার দামুদার নদী ভরা
সেই না নদীতে হারায়ে গেল আমার আশা- ভরসা
পার করো পার করো মাঝি সাঁঝ না লেগে গেলো
ঘরে রয়িছে কাঁচা ছেলে কেঁদে খুন হলো
পার করো পার করো মাঝি আঁধার লেগে গেলো
আমার স্বামী রয়েছে পথো চেয়ে ভেবে আকুল হলো
পার করো পার করো মাঝি রাত ঘনিয়ে এলো
আমার শাউড়ি রয়েছে আশা করে রেগে লাল হলো
পার করো পার করো মাঝি রাত পেরিয়ে গেলো
আমার শ্বশুর রয়েছে ভরসা করে মুখ কালি হলো
পার করো পার করো মাঝি ঠান্ডা লেগে গেলো
চোখের পানি নাকের পানি অঝোর ঝ’রে গেলো…
বলাই বাহুল্য কিডন্যাপ হওয়া বধূটিকে আর কখনো পরিচিত পৃথিবীতে দেখতে পাওয়া যায়নি।
এক একটা গান এক একটা ঠাস বুনোট কাহিনী, একটার খেই ধরে আরো অকথিত কাহিনী উঠে আসে বিয়ের গানের অবয়ব বেয়ে :
ঝিঙে বেচতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
মাছ ধরতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
শাক তুলতে গেলি ঘুরে না এলি, শাকিনা আমার
হাট করতে গেলি ঘুরে না এলি,
শাকিনা আমার
পাইকেরের ফাঁদে পড়লি ঘুরে না এলি,
শাকিনা আমার
খানকি পাড়ার নুংরা ঘরে চালান গেলি
শাকিনা আমার
দোরে দোরে ভিখ মেগে না মান খুয়ালি
শাকিনা আমার….
নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে নেবার সুযোগ না পাওয়া নারীদের স্ববেশে বা লজ্জায় ছদ্মবেশে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। ওই কোনরকম একটা অগত্যার জীবিকা :
কাঠির মালা ঝুমঝুমবালা
কে বা নিবি আয় লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে
হলাম ফিরিআলা লো।
বাবুর বাগান বাড়ীর ভিতর
একদিন কতোই নাচন কোঁদন লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে হলাম ফিরিআলা লো।
শাক তুলিলাম মাছ ধরিলাম
হেনশেল ঘরে কুলুপ লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে হলাম
ফিরিআলা লো।
মোল্লাবাড়ির বিবি আমি
তকদিরে কি ছিল লো।
একটি দুটি পয়সার লেগে
হলাম ফিরিআলা লো….
বাইরে বেরোবার ফলাফল দেখে – ঠেকে শিখে অন্তঃপুরে অগত্যায় নিজেকে আটকে রাখতে শেখে নারী। পুরোটা সংসার চেপে বসে তার ঘাড়ে :
সুপারি কাটুম কুচি কুচি সাজি ভরা পান,
দামাদ আমার এই সারে ( = অসাড়ে) ঘুমান।
দামাদের আব্বার পায়ে রাখি হাজারো সালাম
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
হাঁসো পালি মুরগী পালি, করি গরু চরানের কাম,
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
দামাদের আম্মার ঠেঙে রাখি
হাজারো সালাম।
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
একডা গরু জংলা হইলে
দরমা(=বাজার দর) দিবে কম।
দামাদ আমার এইসার ঘুমান।
দামাদের চাচার ছামুতে রাখি
হাজারো সালাম
দামাদ আমার এইসারে ঘুমান।
______________________
(চলবে)
loading...
loading...
বিয়ের গানে জীবিকা দ্বিতীয় খণ্ড বা পর্ব পড়লাম। যতই জানছি ততোই আরও … আগে পড়বার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। অভিনন্দ বন্ধু। ধন্যবাদ।
loading...
মাত্রই গুটিকয়েক গানের কথা বলেছি । বিয়ের গানের সম্ভার অপার। তবু আপনার ভাল লেগেছে বলে খুশি হলাম।
loading...
ধন্যবাদ বন্ধু।
loading...
আপনার গল্পের সাথে সহমত পোষণ করছি দিদি।
loading...
ধন্যবাদ
loading...
নন্দিত উপস্থাপনা দিদি ভাই। মুগ্ধ হলাম। পরের পর্বের অপেক্ষা রাখি।
loading...
শুভেচ্ছা জানাই
loading...