স্বপ্নহীনের সাপলুডো (একাঙ্ক নাটক)- ১২শ পর্ব

স্বপ্নহীনের সাপলুডো(একাঙ্ক নাটক)- ১২শ পর্ব

জগাই – আমি তো অগ্রাহ্য করিনি স্যারদা।
উকিল – স্যারদা মানে! ওসব ভাঁওতা ছাড়ুন। অগ্রাহ্য করেননি? আপনার বাড়ীতে এই এতবড় চুরির ঘটনা ঘটে গেল, আপনার সর্বস্ব চেঁছেপুঁছে নিয়ে গেল, আপনি সেটা থানায় জানিয়েছিলেন? এফআইআর করেছিলেন?
জগাই – না না সেসব করিনি।
উকিল – অ্যাই ধরেছি। আপনি তাহলে স্বীকার করছেন যে আপনি জেনে বুঝে একটা স্বাধীন দেশের বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, আইন সবকিছুকে উপেক্ষা করেছেন। হুজুর আমার আর কিছুই জিজ্ঞাসার নেই। আসামীর জবাবেই তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণিত। এবার আপনি দেশের আইনানুগ যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করে আদালত তথা বিচারব্যবস্থার ঐতিহ্যকে উজ্জ্বল করে তুলবেন এইটুকুই আমার প্রার্থনা।
বিচারক – হুম। আসামী জগাই ওরফে চতুর্থ জগাই আপনার বাড়ীর দরজা জানলা ভেঙে চুরি হয়েছে, পাঁচ পাঁচজন চোর আপনার বাড়ীতে ঢুকে আপনার পূর্বপুরুষের অর্জিত বিপুল সম্পত্তির বহুলাংশ নির্ভয়ে নির্বিবাদে তুলে নিয়ে গেছে। আর আপনি নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছেন। জেগে উঠে যখন দেখেছেন চুরি হয়ে গেছে তখন কোনোরকম মনস্তাপে না ভুগে অন্য সব দিনের মতোই যথা নিয়মে বাদাম মুড়ি খেয়ে…
জগাই – আজ্ঞে না স্যার! বাফুমু।
বিচারক – ওই হলো। খেয়ে আপনার ডিমের দোকানে গিয়ে বসেছেন। ডিম বিক্রী করেছেন। পরের দিনও তাই। তারপরের দিনও তাই। এমনিভাবে চুরির এতবড় ঘটনা যা আমাদের সনাতন গণতন্ত্রের স্বাধীন দেশের সমৃদ্ধ জীবনের ওপর এক বিরাট ধাক্কা। তা আপনি বেমালুম চেপে গেছেন। এর ফলে চোরেরা উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। তাতে সমাজের সমূহ ক্ষতি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার কি কিছু বলার আছে?
জগাই – আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, বলার অনেক কিছুই আছে। যদি অভয় দেন তো বলি।
উকিল – এখানে সবকিছুই সভয়ে বলো।
বিচারক – হিন্দী সিরিয়াল দেখে দেখে মাথাটা গেছে। সভয়ে নয়, ওটা নির্ভয়ে হবে।
জগাই – হুজুর যে রাতে চুরি হয় আমার ঘরে, আমি ঘুমাইনি। জেগেই ছিলাম। হুজুর, পাঁচজন নয়, মোটে একজন ক্যাংলাপ্যাংলা লোক। নেহাতই হাড়হাভাতে মার্কা চেহারা। রাতের অন্ধকারে চুরি করতে
ঢুকলো আমি বুঝতে পারলাম। তবু ঘুমের ভান করে আমি পড়ে রইলাম। গরীব ডিমওয়ালার ঘরে আর কি আছে?
বিচারক – হ্যাঁ, কি কি চুরি গেছিল?
জগাই – (ম্লান হাসে) যা কিছু ছিল। সেই হাভাতে চোরটা হুজুর কিছু মুড়ি ছিল, সেগুলো জল দিয়ে মেখে গবগব করে খেল। তারপর এক এক করে একটা অ্যালুমুনিয়ামের তোবড়ানো ফুটো ঘটি, বাবার আমলের একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া টেবিল ঘড়ি, ডিম বেচা তেতাল্লিশ টাকা সবই নিল।
বিচারক – তুমি তখনো কিছুই বললে না?
জগাই – আজ্ঞে না হুজুর। তবে ও চলে যাওয়ার সময়ে আমার ভাঙা ঘরের মাটির কুলুঙ্গিতে একটা মাটির দোয়াত আর একটা খাগের কলম ছিল, সে দুটোও যখন ঝোলায় পুরে নেয় তখন আমার বুকের মধ্যেটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।
বিচারক – কেন? কেন? কি মহামূল্যবান জিনিস সেগুলো?
জগাই – বাজারে ওর দাম এক পয়সাও নয় হুজুর। কিন্তু আমার কাছে অনেক। চোরটা যে কেন ওটা নিল?
বিচারক – ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!
জগাই – হুজুর, আমার বাবা লিখতেন। যে সে লেখা নয়, খবরের কাগজে লিখতেন। এখনকার মত ঘটনাস্থলে না গিয়ে হোটেলের এয়ারকন্ডিশনড রুমে বসে মদ খেতে খেতে খবরের গল্প লেখা নয় স্যার। বাবা সত্যিকে সত্যি আর মিথ্যে কে মিথ্যে বলেই লিখতেন। সাদা কে বলতেন সাদা, কালোকে বলতেন কালো। এখনকার ওপরতলার মানুষদের মত চালাকচতুর ছিলেন না উনি। সত্যি কথা লিখতে গিয়ে একদিন খুন হয়ে গেলেন মানুষটা। সেই খুনের কোনো কিনারা হলো না। সব কেমন ধামাচাপা পড়ে গেল। কাগজের মালিক কোনো ক্ষতিপূরণও দিলো না। আমি তখন বেশ ছোট।
বিচারক – তাই নাকি!

(চলবে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩১-০৫-২০১৮ | ১৯:৪৩ |

    স্বপ্নহীনের সাপলুডো (একাঙ্ক নাটক) খুব প্রত্যাশা নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে দীর্ঘ কিছু সময় পেরিয়ে গেছে। জানিও না; লিখাটির সমাপ্তি টানা হয়ে গেছে কিনা। তারপরও ১২ তম পর্ব পড়লাম। অনেক অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় সৌমিত্র। শুভ সন্ধ্যা। Smile

    GD Star Rating
    loading...