দুইটি অণুগল্প


১।
দেশের ভিটেমাটি টুকুও বিক্রী করে ছেলে বাবাকে নিয়ে এলো নিজের বাসায় রাখবে বলে। এরপর এক আরেক পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে বাবা দেখেন দিনদিন প্রতিদিন, অতি কাছের মানুষটির মুখোশের আড়ালের আরেক চেহারা। জীবনকে অনুভব করেন প্রহসনের এক মূর্ত উপহাস রুপে।
অত:পর.. একদিন
এক আলোসবুজ পথ ধরে, কোনো এক সাঁঝের বেলায়, ছেলে বাবাকে ‘বাবা নিবাসে’ রেখে যায়। অতীত বর্তমান তন্ন তন্ন করে সেই প্রথম রাতটিতে বাবা খুঁজে ফিরেছেন কেবলি একটি প্রশ্নের উত্তর, ‘ভুলটা কোথায় ছিল..?
দীর্ঘ সেই রাতটি অবশেষে ভোর হয়েছিল যদিও, একজন বাবা ঐ রাতেই নিজেকে হারিয়েছিলেন।।

#নিশ্চুপ_মাঝরাত

২।
‘নিজকে নিজের মতো স্বার্থক করে নাও, সফলতার মাপকাঠি যেহেতু আপেক্ষিক তাই সবার ক্ষেত্রে সফলতা সম্ভব নয় ।
জীবনের গল্প সুখ দুঃখের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এটাই তো জীবন।’
খুব প্রিয় এবং কাছের মানুষ বলেছিলেন কথাগুলি। বাসায় এলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় জুড়ে বসে শাহেদের। পাশের সোফায় এবং ডিভানে বসে হিন্দী সিরিয়ালে মগ্ন ওর পরিবারের অন্যরা।
ওর কাছের মানুষদের চিন্তাগুলি কি তাদের নিজ নিজ ভূবন গড়ে নেয়ায়, সেখানে শাহেদের অবাধ যাতায়াত নেই দেখেই বোধহয়-ডাইনিং টেবিলে বসলে আসা তাঁর নিজ চিন্তাগুলি ওকে সঙ্গ দেয়? বন্ধুর মত!
চিন্তাবন্ধু নাম দেয়া যায় কি?
একবার বউয়ের দিকে তাকায়। সে তখন টিভির পর্দায়। বড় মেয়ে মোবাইলে নেটে ব্যস্ত। তবে এর ভিতর দিয়ে পর্দার চরিত্রগুলিতে মনোনিবেশ, কি মা’র সাথে টুকরা আলাপ- সিরিয়াল সংক্রান্ত-ই বেশীরভাগ। এরা এক একজন ‘সিরিয়াল বিশেষজ্ঞ’। মেয়ে যে আসলে কি দেখে বা চালায়- শাহেদ আজকাল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
ছোট ছেলে ও ব্যস্ত। এরা দু’ভাইবোন সারাদিন ইংরেজি f আকৃতির মত ডিসপ্লের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। অফিস যাওয়া আসার পথে, এমন বাস ভর্তি f দের চোখে পড়ে আজকাল শাহেদের। ছেলে এখন গেমস খেলছে।
ওদের সবার একটা আলাদা জগত গড়ে উঠেছে। শাহেদের জগত কোনটা? সে তো এদেরকে নিয়েই এক জগতের সন্ধানে জীবন পার করছে। ওরা কি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা? ওদের প্রবেশ পথে কি এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে ‘No Trespassing For You Only’?
নিজের চাকরি, দিনের প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা খেয়ে ফেলে যাওয়া আসা মিলিয়ে। বাকিটুকুতে যা সময় দেয়া সবাইকে। হাতে থাকে বন্ধের দিন। ঘুমকাতুরে শাহেদ ঘুমে কাটায় প্রায় দিনের অর্ধেক।
‘ এই সাইনবোর্ডের দায় তোমার কি নেই একটু ও?’
নিরবে ভাতের দলা নাড়াচাড়া করছে দেখে, টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মিলি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? রান্না ভাল হয়নি নাকি?
শাহেদ নিরুত্তর থেকে মাখানো ভাতের এক দলা মুখে দেয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মিলি। একটু কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে? সিরিয়ালের ‘ক্রুশিয়াল মোমেন্ট’ চলে যাচ্ছে? ভ্রুর হাল্কা কুঞ্চন কেন তবে? অবশ্য আজকাল শাহেদ অনেক ভুলভাল দেখে। বকে। ভাবে ও সেভাবে.. নিজের মনে।
এত ভুল কেন জীবনে? মস্তিষ্কের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মন। মিলি কিছু জিজ্ঞেস করায় মন আর সে- দু’জনেই ওর দিকে ফিরে তাকায়,
– অফিসের হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে এখন আমার রান্না ভাল লাগছে না আর?
ভাতের প্লেট একটু দূরে ঠেলে দেয় শাহেদ। বাউলে পানি ঢেলে হাত ধোয়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে। তৃষ্ণা মেটে?
এরপর মিলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– সিরিয়ালগুলিতে আজকাল এসব ও শিখাচ্ছে নাকি?
– মানে?
নাকের উপরটা কাকলাসের শরীরের মত লাল হয়ে উঠে মিলির। এক্ষুনি রেগে যাবে। শাহেদ সামাল দেয় এই বলে,
– তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার রান্নার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না আমার কাছে। তারপর ও আউল ফাউল কথা কেন বলো?
আগের রঙ ফিরে পায় নাকটি। তবে ওখানেই সব শেষ হয় না। সিরিয়াল গুরুত্ব হারিয়েছে নারীর কাছে! সে এখন আবেগী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন মিলি জানায়,
– দেখলাম তো, কখনো তোমার খাবার হোটেল থেকে কিছু এনেছ আমাদের জন্য?
ছেলেমেয়েদেরকে ও নিজের দিকে টানার অপচেষ্টা? সফল হয়। ওদের কান হরিণের মত। সবসময় খাড়া সজাগ থাকে। তবে এদের সাথে হরিণের পার্থক্য এক জায়গায়, হরিণ যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে সজাগ হয়। ছেলে আর মেয়ে, তাদের বাবার বিপক্ষে যায় এমন সব কথায় f পজিশন থেকে I অবস্থানে চলে আসে।
দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে আক্রমনে নামে মিলি,
– বৃহস্পতিবার দুপুরে খাও না তো, তরকারিটা আমাদের জন্য নিয়ে এলে ও তো পারো? বিল তো দেয়া-ই লাগে।
এবার অসহ্য লাগে শাহেদের কথাবার্তাগুলি। মস্তিষ্ক বিপদ সংকেত দেয়। ক্রোধ বিপদজনক সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে। শাহেদের ইচ্ছে করে মিলিকে এগুলি বলতে,
– তুই আর তোর মা হলি খয়রাতির জাত। জীবনে খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝলি না?
বউয়ের মা’কে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই অহেতুক টেনে আনা হয়। ভদ্রমহিলারা বেশীরভাগ সময়েই আরোপিত অভিযোগের সাথে সামান্যটুকুর ও সংশ্রব রাখেন না। তারপর ও বউকে কথার আঘাতে তীব্রভাবে ঘায়েল করতেই ওনাদেরকে আনার লোভটুকু স্বামীরা কেন জানি সম্বরণ করতে পারে না।
কিন্তু মিলির দিকে তাকাতেই সব ভুলে যায় সে। নাকের নিচটা ঘেমে ভিজে আছে মিলির। তীক্ষ্ণ চোখে শাহেদকে দেখছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল উড়ছে তাঁর। অবাধ্য দু’একটা চুল চোখের উপর পড়েই সরে যাচ্ছে। ডান গালের তিল.. এসব কিছু মিলিয়ে মিলিকে দেখে শাহেদের রাগ পড়ে যায়.. ধীরে ধীরে। সেই অদৃশ্য সাইনবোর্ডটির অস্তিত্ব এই মুহুর্তে আর অনুভব করে না একটুও!
মিলি ও কি শাহেদের এখনকার পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করছে?
মিলিকে ধরে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে শাহেদের। আপনাতেই শাহেদের টোন চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজে ও টের পায়না কিভাবে কি বলছে সে,
– আসলে টানাটানির ভয়ে আনি না আমি। অন্য কিছু না।
মিলি অবাক হয়! লোকটা একটু ও গালাগাল করলো না আজ! কিন্তু ক্রোধের শুরুটার সকল উপসর্গ শুরু হয়েছিল। দেখেছে ও সে। আবার কেন জানি তীক্ষ্ণ রেখাগুলো সমান হয়ে মিলিয়ে ও যায়। ঐ দু’টি চোখে সেই প্রথম দিনের ভাললাগার চমক এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছে সে। শাহেদের চোখে।
চোখ?
কোন চোখ?
একজন পুরুষের কতগুলি চোখ থাকে?
তবে শাহেদের চোখে তাকালে সেই প্রথম থেকেই নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হত মিলির! আজ বহুদিন পর সেই ইচ্ছেটার জন্ম হচ্ছে দেখে মিলি ও অবাক হয়। ওর পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে!
‘নাহ! আমার মানুষটা আমাকে এখনো আগের মত ফিল করে! আমি ও করি। ওকে আমার আরো সময় দেয়া দরকার।’
নিজের খোলস বদলে এক অতিপরিচিত মিলি উঠে দাঁড়ায়। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে,
– চলো, হাঁটতে বের হই। তুমি-ই তো বলো সবসময়- after dinner walk half a mile, কি? বলো না?
মেয়ে এবং ছেলের অবাক চাহনির সামনে শিহাব দাঁড়িয়ে মিলির প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা Smile বলেছি অনেকবার আমি। চলো, বের হই।
রাতের প্রথম প্রহরে নির্জন পিচের পথে, এক জোড়া নব-দম্পতি হাত ধরে হেঁটে চলে। কিছুক্ষণ আগে ওদের খোলস বদল হয়েছে। হৃদয়ের পলেস্তারা খসে খসে- হৃদয়গুলি নতুন হৃদয়ে পরিণত হয়। হৃদয়ের পুনর্গঠন!
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি?

#হৃদয়ের_জোছনায়_বসে_থাকা

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১০-১১-২০১৭ | ২২:২৪ |

    বেশ কিছুকাল আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর অণুগল্পের আশেপাশে ঘুরাফেরা করেছি। প্রত্যেকটি লিখাই পরস্পরকে যেন অতিক্রম করে। তারই রেশ ধরে অধুনা আপনার লিখার সাথেও ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে আমার। আপনার অণুগল্পেরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট রয়েছে। যেহেতু আপনার ধরন এবং গড়ন এর সাথে পূর্ব পরিচয় রয়েছে … এমন কিছু কারণে আপনার লিখা পড়ার প্রতি প্রায়োরিটি আমার সবসময়ই বেশী থাকে। ভালো লাগে। Smile

    ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা প্রিয় সব্যসাচী মি. মামুন। অল দ্য ভেরি বেস্ট। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১১-১১-২০১৭ | ২৩:৩৭ |

      লেখালেখির শুরু এবং ব্লগিং এর প্রারম্ভিক পর্যায়ে, সব সময় আপনি অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছেন। তাই এই পথ চলা একটুও বন্ধুর মনে হয়নি ভাইয়া।

       

      অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা আপনার জন্যও।

      GD Star Rating
      loading...
  2. আনু আনোয়ার : ১১-১১-২০১৭ | ১৬:২০ |

    অনেক দিন পরে শব্দনীড়ে এসে মামুন ভাইয়ের সুন্দর দুইটি অণুগল্প পেয়ে ভাল লাগল। আশাকরি ভাল আছেন। 

    GD Star Rating
    loading...
    • মামুন : ১১-১১-২০১৭ | ২৩:৩৯ |

      অনেক ধন্যবাদ প্রিয় আনু ভাই।

      জি, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_dance.gif

      GD Star Rating
      loading...