বারো ঘন্টা প্লাস
(দ্বিতীয় পর্ব)
আবার একটা ট্রেন এল, দু’চারজন লোক নেমে পেয়ারা বাছতে উন্মুখ। একটু সরে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করল মীনকেতন। মৃত্যুর আগে কতো যে ধ্বংস পেরিয়ে যেতে হয় একজন মানুষকে! গা থেকে এভাবে মাংস খসে যেতে যেতে শেষদিন যখন বাজপাখির ফাইনাল ছোঁ এসে নামবে, তখন মুখ দিয়ে যাতে একমাত্র ‘থ্যাংক ইউ’ বেরিয়ে আসে, তার জন্যেই জীবনের এখানে ওখানে এত সাপ-হায়না-নেকড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে? দুই হাঁটু জড়ো করে বসা মেয়েটাকে এক শ্যামকপোতী মনে হতে থাকে মীনের। খদ্দের ছেড়ে দিয়ে তাকে আবার ইশারায় ডেকে নেয় কপোতী, মানে সুলতানা।
— আমাদের গেরামে তোমারে একবার লে যাবো। ঝেকানে ইছেমতী বাঁক লেচে, সেই মোক্তারপুরে এক পীরসায়েব থাকে, ক্যামোন? সে তোমার তাবিজ-কবোচ কত্তি পারে। আর সবায়েরে বলে, খোদার নাম লে বে-মতলব কাজ করবা। মান্সের উপ্কার কোত্তি থাকপা বে-মতলব। এই তোমারে দেখায়ে পীরসায়েবেরে বলবো ভেবিচি, এট্টা লোক পাওয়া গেচে দুনিয়ায়, যে কোনও ফিকির না খুঁজে অচেনা লোকেরে হামেশা জলখাবার দেচ্চে।
হঠাৎ ঘাড়ের কাছে বিকট থুতু ফেলার শব্দে চমকে উঠতে হয়। মীন মুখ তুলে দেখে কখন তার চারদিকে ছ’-আটজন লোকের ঘেরাটোপ তৈরি হয়েছে। চেহারায় বা ভাবভঙ্গিতে ট্রেনের যাত্রী বা স্টেশনের দোকানদার মনে হয় না। মানুষগুলো সেই শ্রেণীর যারা রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে জামাকাপড় পরে ঘর থেকে বেরোয় আর অনেক রাতে ফিরে ওই জামাপ্যান্টেই শুয়ে পড়ে। মাঝখানে ফুটপাথের দোকান থেকে দিনমানে ধারে বা অন্যের পয়সায় চা। এভাবেই দুপুরে পাঁউরুটি-ঘুঘনি হয়ে গেল তো রাতে অতি অবশ্যই একটু গাঁজা বা ছোট পাউচ চুল্লুর।
সারাদিন রাস্তার পাশে বসে চারদিকে ধেয়ে যাওয়া জনস্রোতে এরা নজরের ছিপ ডুবিয়ে আছে। কোন কিশোরি বাড়িতে ঝগড়া করে পালিয়ে একা স্টেশনে নামল, কোন বাচ্চাটা ভিড়ের মধ্যে মাকে হারিয়ে ফেলেছে, বা রাস্তায় হঠাৎ বাওয়াল বাধলে কার সাইড নিলে কিছু ইনকাম। এরা সেই অভিজ্ঞ ভালুক যারা ঝর্নাজলের পাশে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে ওঠা মাছগুলো মুখে পুরে নেয়।
ভিড়ের একটা ছেলে, বাঁহাতে খৈনি ডলছে, তার ওপর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে জিগেস করল, ঝুড়ির পেয়ারা খাবে, না বৌদির পেয়ারা? ফুঁসে উঠল সুলতানা।
— আরে শালা মোজাম্মেল, আরে হারামির বাচ্চা রতন, আজকেরে ঝা অপমান করার করি লাও। কাল থেকে এ গু-মুতির জায়গা জম্মের মতো ছেড়ি দোবো। তোদের মস্তান দাদারে জানায় রাখিস, জাল পাতলিই সব পাখি গোত্তা খেয়ি পড়বে, অ্যাতোডা মাগনা পাওনি বলো।
৩
বাইপাস ধ’রে ছোটা বাসের জানলায় বসে সে ব্যাগ থেকে সুলতানার কাছে কেনা পেয়ারাটা বের করে। তারপর ফাস্ট বোলারের মতো নিজের উরুতে কয়েকবার পালিশ করে নিয়ে এক কামড় বসায়। তৎক্ষণাত হুড়মুড় করে মীনকে আক্রমণ করে তার শৈশব।
যেন ঠাকুমার সরু সরু সাদা হাতের ছাল উঠছে,এই আন্দাজে সে পেয়ারার ডাল থেকে হালকা ঘষায় খোসা ফেলে দিত। এবং তখন কী মসৃন, কী শীতল পেয়ারাগাছের ডালপালা! নিজের থমথমে কিন্তু পাতলা গাল মীন রাখতো ওখানে। একটা গিরগিটির মতো সে তখন উপুড়, ডাল বুকের তলায় কঠিন পৈতের মতো প্রশাখা, উরুসন্ধি চেপ্টে আছে তারই গায়ে। মীনের ছোট্ট পুরুষ, এবং অল্প দুটিখানি লেবু লজেন্সের মতো অণ্ডকোষে শুক্রবীজ তৈরি হওয়ার ভিয়েন বসেনি। ফলে মীনের শরীরের সব পর্বসন্ধিতে তখনও কুসুমগন্ধ লেগে। এবং ভুললে চলবে না, পেয়ারার ডাল একটি ভরসাকেন্দ্র; আতাগাছের মতো নয় যে দেখাবে তো খুব মোটা-কালো রঘু ডাকাত, কিন্তু গত বছরই মড়মড়িয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে নাক থেকে কতখানি রক্ত উদ্গীরণ করিয়ে দিল!
আজও প্রতিদিন পেয়ারায় কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের বনজ গন্ধে ভর করে আলাদা আলাদা দৃশ্য ও কাহিনি ছুটে আসে। যেমন গত পরশু ঝুড়ি থেকে নিজেই বেছে যে পেয়ারাটা তাকে দেয় সুলতানা, তার প্রথম টুকরো মুখে চালান করামাত্র শুকদেবদার বাড়ির গাছটার কথা মনে পড়ে গেল। সেই পেয়ারার গায়ের গন্ধ ছিল অবিকল ওইরকম।
তুমুল হাওয়া তার লম্বাটে চুলে ঝড় তুলে দিয়েছে। অফিসে পৌঁছোনোর ছোট্ট গাড়ি নিজেকে টেক অফ করার আগের মুহূর্তের বিমান ভেবে নিল নাকি! রাস্তার মাঝখানের আলোস্তম্ভ দু’ডানা ছড়ানো সার সার অ্যালবাট্রস। যেন কাছাকাছির মধ্যে কোথাও, জানলা দিয়ে ঘাড় একটু টান করলেই, দেখা যাবে সমুদ্র। শহরের ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে সাঁ করে এমন শূন্যতা জীবনে প্রথমবার সে দীঘা গিয়ে পেয়েছিল। তার অনেক বছর পরে সদ্য বিয়ে করা বন্ধু তাকে শোনায় আনকোরা যৌন-অভিজ্ঞতা। মীনকেতনের চোখে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠেছিল ওই দীঘা, ওপরে হেমন্তের ধূষরতা টাঙিয়ে রাখা নীল সমুদ্রের শোষণধ্বনি।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোনবুকে গেল মীনকেতন। নামগুলো ফ্লিপ করতে করতে পাঁচ-এ অগ্নিশুদ্ধা, আজ পাঁচ বছর হল মীনের বাড়তি দুটো হাতের মালকিন ইনিই। অবশ্য মীন তাকে কখনও আঁখি ছাড়া ডাকেনি, দুজনের নাম যোগ হয়ে মীনাক্ষি হয়ে যাওয়াটা তার কাছে বাংলাভাষার সবচেয়ে আশ্চর্য কবিতা! আঁখিকে মীন এখুনি শোনাতে চায় সেই পেয়ারা-বেচা মেয়েটার কথা। জানো, সুলতানা বলে কি, জীবনে অনেক অন্যায়ের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আল্লাহ চিরকালই কিছু কিছু মানুষের ভেতর দিয়ে তার করুণা পাঠিয়ে চলেন। তাই সে খারাপের সঙ্গে আর কোনও সমঝোতায় যাবে না। সিম্পলি ভাবতে পারছি না, আমার মতো খ্যাপাটে, আত্মবিশ্বাসহীন একটা লোক কাউকে এভাবে ইন্সপায়ার করতে পারে…।
কিন্তু চার-পাঁচবার ডায়াল করেও দেখা গেল আঁখি এতটা জরুরি এনগেজড, এখন তার নম্বর ধরবে না। একটু দমে গেল মনে মনে আর তখুনি পালটা বেজে উঠল অনিমেষের, মীনের অফিসের বন্ধু। খুব একটা গ্রহণযোগ্য খবর শুনিয়েছে সে, কেননা খুশি মুখে স্টপেজ ছেড়ে যাওয়া বাস থেকেই লাফিয়ে নেমে পড়ল মীনকেতন।
দুপুর দুটো
গরম হাওয়ায় চোখ-মুখ অন্ধ করে দিয়ে অটো এসে থেমেছে গলির মুখটায়। পেছনে ধুলো-ওড়া ব্রিজের নিচে পচা নিঃস্রোত জলের খাল। সামনে গেরুয়া রঙ চারফুট উঁচু বিষ্ণুমন্দির। মানুষের চোখ-নাকের মতো গর্ত আর ঢিবিতে ভরা রাস্তার ওপর টুপির কানাতের মতো ঝুঁকে এসেছে ঠাসা দোকানঘরের ছাদ। তবু ঘন বিকেল নেমে রোদের তাত কিছু জুড়োলে শহরের এই রাক্ষসরূপ পাল্টায়। যদিও বর্ষার জমা জল জামাকাপড়ে ছিটকে আসার আদলে কানে লাগতে থাকে বাইক আর প্রাইভেট গাড়ির হর্ন, তবু অপরিচ্ছন্ন নারীর প্লাক করা ভুরু যেমন, চিলতে পানের দোকানের মাথাতেও গ্লো-সাইন জ্বলে ওঠে। সকালে দেখা শনি ঠাকুরের মতো এই বিষ্ণু দেবতারও হাত চারখানা। কিন্তু আজকের বিশিষ্ট দুপুরে ঠাকুর-দেবতাকে অতটা হিংসে করার মন নেই মীনকেতনের। পাঁচ বছর আগে যেমন, আজও কান-গরম আর বুক-ধড়াস নিয়ে সে চারতলা ফ্ল্যাটের মাথায় উঠে এল। তারপর কলিং বেলে হাত রাখতে গিয়েও কী ভেবে সরে এসে রিং করল আঁখির ল্যান্ড লাইনে।
— দেখেছ, আমি জানতাম তুমি অফিসে যাওনি।
— আহা, আমি নিজেই তো কাল রাতে বললাম, নাও যেতে পারি। শরীরটা একদম ভালো লাগছে না গো! আজ গোটাদিন ঘরে শুয়েই কাটাব।
স্পষ্টতই আঁখি মিন করছে, আজ বিকেলেও দেখা করতে রাজি নয়। মানে, পাক্কা তিন সপ্তাহ তারা মুখোমুখি হল না।
— আজ অফিস কাটার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। যাব তোমার কাছে, সোনা?
(চলছে)
loading...
loading...
বারো ঘন্টা প্লাস (দ্বিতীয় পর্ব) পড়লাম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সবকটি পর্ব শব্দনীড়ে প্রকাশিত হলেও সবকটির মধ্যে এই দ্বিতীয় পর্বটিই বাদ পড়ে গিয়েছিলো। সুতরাং পুনরায় দ্বিতীয় পর্ব থেকে শুরু হলো। সঙ্গে আছি।
loading...