ছোটদের গল্প
কুইন অ্যান এবং লাভা-র ভূত
ভূত-বিজ্ঞান
বাবা বলেছিল, আজ অফিস থেকে ফেরার সময় ঘড়িদাকে নিয়ে আসবো। আমাদের টেবল-ক্লকদুটো সারানো দরকার।
তবে আমার ভুলোমন পিতাজি যে সত্যি-সত্যি সন্ধেবেলা ভদ্রলোককে সঙ্গে করে বাড়ি ঢুকবে, এতটা আমরা মা-মেয়েতে আশা করিনি।
নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করে ঘড়িদা (আমার ঘড়িকাকু?) কয়েকমাসের অকেজো সময়মাপক যন্ত্রদুটোকে চালিয়েও দিলেন মিনিট কুড়ির মধ্যে। তারপর সবাই মিলে বসা হল বাইরের ঘরের সোফায়।
বাবার মুখে এবার ব্রেকিং নিউজ: তোদের কখনও বলার সুযোগ হয়নি তানিয়া, ঘড়িদা মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে খুব ইন্টারেস্টেড। আর একটা ব্যাপারেও ওর বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি আছে — অশরীরি আত্মা।
শুনে আমার গা রি-রি করে উঠবে এতটা না হলেও পরিষ্কার বলছি, খুব বোকা-বোকা লাগে এই আলোচনাগুলো।
কাজেই, “আপনি নিজে কখনও ভূত দেখেছেন?”-ই ছিল আমার আধা-বিনয়ী চ্যালেঞ্জ। ঘড়িকাকুই বুঝে নিন, আর এগোবেন কিনা।
ভয়ও ছিল, উল্টে “তোমাকে যেমন দেখছি, তেমনি দেখেছি ভূতকেও” এরকম কথামৃত-মার্কা কিছু শুনে ফেলতে পারি। না, ঘড়িকাকু মাঝামাঝি পথে হাঁটলেন।
— যে দেখতে চায় তাকে সাধারণত দ্যাখা দেয় না। ভিতুকে ভয় পাইয়েই প্রেতাত্মার আনন্দ।
এমত বলে ঘড়িকাকু উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছেন। শ্রাবণ মাসের সন্ধে, আর এক পশলা বৃষ্টি উপহার দেওয়ার বন্দোবস্ত করছে কালো আকাশ।
বাবা মুচকি হেসে আমার পাশ থেকে উঠে গেল রান্নাঘরে তারপর মায়ের ইশারা পেয়ে ছাতা হাতে রাস্তায় — যদি খুব ভুল না ভেবে থাকি, মোড়ের রজতদার দোকান থেকে বেগুনি আর মিষ্টি সিঙাড়া কিনে আনতে।
ঘড়িকাকু কন্টিনিউ করছেন: এই ইঁট, সিমেন্ট, পাথরের দুনিয়াতে যেমন প্রজাপতি বিরল হল, তেমনি ভূতও বিরল প্রজাতি হয়ে উঠবে, কারণ সেটাই স্বাভাবিক!
রান্নাঘরে থাকলেও মায়ের কান যে এদিকেই, বোঝা গেল তার গলা-উঁচু প্রশ্নে:
শামুক, ফড়িং, ঝিঁঝিঁপোকা এসব নয় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভূতদের তো মৃত্যু নেই, তারা মরে ভূত। তাহলে?
খুব সৎ জিজ্ঞাসা। কিন্তু ঘড়িকাকু লেগস্ট্যাম্পের ওপর ফুলটস পেয়েছেন। আবার এক-পশলা উদাস শান্ত হাসি দিয়ে জানালেন:
ভূতেরা মরে যাচ্ছে বলিনি তো! সরে যাচ্ছে। আগে গৃহস্থ পাড়ার আনাচেকানাচে বা হাটবাজারের রাস্তায় মেছোভূত ঘুরত মাছ খাওয়ার লোভে। দুষ্টু ছেলে ভরদুপুরে বাগানের আম চুরি করছে, গেছোভূত মাথায় ঢিল মেরে তাকে বাড়ি পাঠাত। কিম্বা ধরো, পাড়ার নতুন বউ কাউকে না জানিয়ে রাতবিরেতে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়, পেত্নী তার খোলা চুল বেয়ে উঠে বসতো ঘাড়ে। এখন সব জায়গায় আলো, সর্বত্র মানুষ। ভূতেরা তাই ওপরের নানান বায়ুস্তরে উঠে গেছে।
— আসলে বিজ্ঞানই সেই আলো, বুঝলে ঘড়িদা? আলো যত ছড়াবে, ভূতদের ফিউচার টেন্স ততই ডার্কনেস। কী বলিস, তানি? বাবা বেগুনির বদলে ডালের বড়া নিয়ে ফিরেছে।
ঘড়িকাকু হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন: কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস নাইন।
তুমিও বাবার সঙ্গে একমত?
মোটামুটি হ্যাঁ। দেখিনি, তাই বিশ্বাস করি না। এভাবে বলা চলে যে আপনি যদি মানতে চান তবে ভূত আছে, না মানলে নেই।
— হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন বিক্রিয়া করে জল তৈরি হয়, ঠিক তো?
— হুঁ।
— দেখেছ কখনও?
— না, কিন্তু তাতে কী? এ-তো বিজ্ঞানের আবিষ্কার। ব্যবস্থা করলেই দ্যাখা বা দেখানো যেতে পারে।
— লক্ষ লক্ষ মানুষ ভূত দেখেছে, লিখেও গেছে নিজেদের অভিজ্ঞতা। তাদের কথায় বিশ্বাস করছ না কেন?
— তারা কি আমাকে ভূত দেখাতে পারবে?
আলবৎ পারবে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়া চাই। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন দুটো গ্যাস এমনি মিশিয়ে দিলেই তো আর জল হয় না। বিশেষ তাপমাত্রা, বায়ুস্তরের চাপ আর অনুঘটক লাগে রিঅ্যাকশান করাতে। এটাকেই পরিবেশ বলছি। এমন অনেক হানাবাড়ি রয়েছে যেখানে গেলে অশরীরি আত্মা যে রয়েছে সেই অনুভূতি মনে আপনা থেকেই জোরালো হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগে একটা পত্রিকায় বেশবিদেশের প্রাসাদ আর দুর্গের খবর বেরিয়েছিল, যেমন ইংল্যান্ডের উইনসর কাসল, স্কটল্যান্ডের এডিনবরা কাসল, বা আমাদের রাজস্থানের ভানগড় দুর্গ। জানো কি, সে-সব ট্যুরিস্ট স্পটে মানুষ পয়সা খরচ করে ভূত দেখতে ছোটে!
কাকুটাকে আমার ভালো লেগে যাচ্ছে! না, ভূতে রাজি হয়ে গেছি এমন নয় মোটেই। অশরীরি সত্তার ওপর এত বিশ্বাস আর মায়া — যেন তারা সবাই ওর নিজের লোক, আত্মীয়স্বজনের মতো!
এবার ইন্টারভ্যাল ঘটিয়ে দিয়ে দৃশ্যের ভেতরে মা ঢুকে পড়ল, হাতে যথারীতি দুরকম স্বাদ — নোনতা আর মিষ্টি। সঙ্গে ঘোষণা:
— এসব বিশ্লেষণ এখন থাক, দাদা। আপনি বরং নিজের চোখে দ্যাখা ভূতের একটা গল্প বলুন, আমরা জমিয়ে শুনি। তারপর ভেবে দেখব, ভূতে বিশ্বাস করা যায় কিনা।
( সবে ভূতের সন্ধে… )
loading...
loading...
প্রথম খণ্ড পড়লাম প্রিয় লেখক চন্দন দা।
আপনার হাতে যে কোন গল্প উঠে আসা নিঃসন্দেহে তা অসাধারণ হবে। গুড লাক।
loading...