“একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা”— এই উক্তিটি প্রখ্যাত মনীষী ও দার্শনিক নেপোলিয়ন বোনাপার্টের। কিন্তু আমরা আজ এই একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ নারী এখনো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, আর এর প্রধান কারণ বাল্যবিবাহ।গত এক দশক ধরে কিশোরী মাতৃত্বের হারের দিক থেকে পৃথিবীর শীর্ষ তিনে রয়েছে বাংলাদেশ। যেটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য এবং Digital Bangladesh অর্জনের পথে বাংলাদেশের জন্য বড় বাধা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসকরা মনে করেন, কিশোরী বয়সে মা হলে, মা ও সন্তান দুজনেরই স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে যায়।দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছরের কিশোরীদের মধ্যে প্রজনন হার প্রতি এক হাজারে ১৩৫ জন। যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। কিশোরী মাতৃত্বের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশ ।
বাল্য বিবাহ কি ? :
বাল্য বিবাহ বলিতে সেই বিবাহকে বুঝায় যাহাতে সম্পর্ক স্থাপনকারী পক্ষদ্বয়ের যেকোনো একজন শিশু। শিশু বলিতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝাইবে যাহার বয়স পুরুষ হইলে একুশ বৎসর কম এবং নারী হইলে আঠার বৎসরের কম।
বাল্যবিবাহের তথ্য:
১. জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের ৫ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে ।মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে – মাত্র একহাজার টাকার দেনমোহরে বিয়ে হচ্ছে এই সব সুবিধা বঞ্চিত মেয়েদের যাদের বয়স ১২ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে – কোন দেন মোহরই ধার্য করা হয়নি এমনকি বিয়ের রেজিষ্ট্রেশনও করা হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে বড় অংকের যৌতুক দাবী করছে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির পরিবার।
২. ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০-১৯ বছর বয়সের দুই তৃতীয়াংশ কিশোরী বাল্য বিবাহের শিকার হয় ।
৩. সেভ দ্যা চিলড্রেন এর ২০১০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ।
৪. জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার ২০০৯ সালে ছিল ৬৪ শতাংশ, যা ২০১১ সালে এসে দাড়িয়েছে ৬৬ শতাংশে।
৫. বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর ৩ মাস ।
৬. ইউনিসেফের পাপ্ত তথ্য মতে দেশে আঠারো বছর পূর্ন হবার আগে বিাহের হার ৬৬% এবং ১৫ বছরের আগে বিবাহের হার ৩২%। ৭. বাংলাদেশে গর্ভবতি নারীদের মধ্যে ৫৭% বয়স উনিশ এর নিচে। বাল্য বিয়ের কারনে ৪১% মেয়ে স্কুল ত্যাগ করে।
বাল্য বিবাহের কারনসমূহ:
১.সাধারনত মেয়েদের অর্থনৈতিক অবস্থার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাল্যবিবাহে উৎসাহিত করে ছেলেদের পরিবার।
২.কখনও কখনও তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার প্রবনতা থেকেও বাল্য বিবাহের দিকে ঝুকে পড়ে গ্রাম্য পরিবারগুলো।
৩.ভবিষ্যতে ‘কন্যাদায়’ যেন বড় খরচের দায় হয়ে না দাঁড়ায় সেকথা মাথায় রেখে অল্পবয়সে বিয়ে সেরে ফেলতে পারলে একটা “খরচের দায়” কমে গেল, এই ভাবে ।
৪. ইভটিজিং এ দেশের সমাজ ব্যবস্থা এখনও নারীকে পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাই তারা তারি মেয়েদের বিয়ে দেন।
৫.অধিকাংশ পিতামাতা ছেলেকে শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম করায় যতটা মনযোগ দেন মেয়ের জন্য ততটা দেননা, বরং তাকে ‘বিদায়’ করতেই আগ্রহী থাকেন, যা বাল্য বিবাহের অন্যতম কারন
বাল্য বিবাহের প্রধান কুফলঃ
১.নারী শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হওয়া ছাড়াও বাল্য বিবাহের কারনে মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন মা মারা যাচ্ছেন।
২. প্রতি ঘন্টায় মারা যাচ্ছে একজন নবজাতক৷ নবজাতক বেঁচে থাকলেও অনেকসময় তাকে নানা
শারীরিক ও মানষিক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়৷
৩. অপ্রাপ্তবয়স্ক মা প্রতিবন্ধী শিশু জন্মদান করতে পারে৷
৪.বাল্য বিবাহের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদের আশংকা তৈরী হওয়া ছাড়াও নানা পারিবারিক অশান্তি দেখা দেয়৷ ।
৫. বাল্যবিবাহ শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি করে না, পারিবারিক, সামাজিক এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধনেও সহায়ক হয় । যেমন, শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্যগত কারণে অল্প বয়সের মেয়েটি তার নিজের সম্পর্কে সচেতন নয়, সুতরাং পরিবার সম্পর্কে তার ধারণা না থাকায় স্বাভাবিক বিষয়।
বাল্য বিবাহ নিবারণ করার জন্য আইন
বাল্য বিবাহকারীর শাস্তি:
যে কেউ একুশ বত্স র বয়সোর্ধ্ব পুরুষ বা আঠারো বয়সোর্ধ্ব মহিলা হয়ে কোন বাল্যবিবাহের চুক্তি করলে, একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাবাসে বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য জরিমানায় বা উভয়বিধ শাস্তিযোগ্য হবে।
৫। বাল্যবিবাহ সম্পন্নকারীর শাস্তি :
যে কেউ যেকোন বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠান, পরিচালনা বা নির্দেশ করলে তিনি এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাবাসে, এক হাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য জরিমানায় বা উভয়বিধ দন্ডে শাস্তিযোগ্য হবেন, যদি না তিনি প্রমাণ করেন যে, তার বিশ্বাস করার কারণ ছিল যে, উক্ত বিবাহ কোন বাল্যবিবাহ ছিল না।
৬। বাল্যবিবাহ সংশ্লিষ্ট পিতা-মাতার বা অভিভাবকদের জন্য শাস্তি :
যেক্ষেত্রে কোন নাবালক কোন বাল্যবিবাহের চুক্তি করে, সেক্ষেত্রে ঐ নাবালকের ভারপ্রাপ্ত যেকোন ব্যক্তি, পিতা-মাতা হইক বা অভিভাবক হইক বা অন্য কোন সামর্থ্যে হউক, আইনসম্মত হউক বা বেআইনী হউক যদি উক্ত বিবাহে উত্সাহ প্রদানের কোন কাজ করেন, অথবা উহা অনুষ্ঠিত হওয়া হতে নিবারণ করতে অবহেলার দরুন ব্যর্থ হন, তিনি এক মাস পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য বিনাশ্রম কারাবাসে বা একহাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য জরিমানায় বা উভয়বিধ দন্ডে শাস্তিযোগ্য হবেন :
তবে শর্ত থাকে যে, কোন মহিলাই কারাবাসে শাস্তিযোগ্য হবে না।
এই ধারার উদ্দেশ্যে যদি না এবং যতক্ষণ না বিপরীত কিছূ প্রমাণিত হয়, এই অনুমান করতে হবে যে, যেক্ষেত্রে কোন নাবালকের বাল্যবিবাহের চুক্তি করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে উক্ত নাবালকের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ঐ বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়া হতে নিবারণ করতে অবহেলার দরুণ ব্যর্থ হয়েছেন।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের উপায়ঃ
১. বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনটি বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রচার/প্রচারনা করা প্রয়োজন৷
২. রেডিও, টেলিভিশনে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বাল্য বিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগনকে সচেতন করা যেতে পারে৷
৩. গ্রাম পর্যায়ে উঠান বৈঠক ও মা সমাবেশ এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনে প্রশাসনের পক্ষ করা যেতে পারে৷
৪. জন্ম নিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোন অবস্তুায়ই নিকাহ রেজিষ্টার যেন বিবাহ নিবন্ধন না করেন, সেরূপ আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে৷
৫. প্রতিটি ইউনিয়নে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা যেতে পারে৷
৬. নবম ও দশম শ্রেনীর পাঠ্য বইতে এ বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করা হলে এর সুফল পাওয়া যাবে৷
৭. জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বেসরকারী সংস্তুাগুলোও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে৷ আমরা যারা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাজ করছি- পরিসংখ্যান ও বাস্তবতার দিক থেকে সফলতা দেখালেও অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে শিশু বয়সী মেয়েদের বিবাহের মাত্রা সামাজিক অস্থিরতা, নিরাপত্তার অভাব, বেকারত্ব, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, পারিবারিক ভাঙন ও অবক্ষয়ের কারনে। যে সব সুবিধাবঞ্চিত মেয়েরা স্কুলগামী হচ্ছে তারা ঝরে পড়েছে এবং তাদেরকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে একটা অনিশ্চত জীবনের দিকে। দেখতে হবে শিশুবান্ধব স্কুলের জন্য যে যে অপরিহার্য শর্ত রয়েছে তা আছে কিনা।এই প্রয়াসে আমাদের জানা প্রয়োজন “শিশুবান্ধব স্কুল” (Child Friendly School)কি? কি কি বিষয়ের উপর আমাদের নজর দিতে হবে। আইনকে কার্যকর করার সাথে সাথে মেয়ে শিক্ষার সুফল প্রকাশ্যে দেখানোর জন্য যে কোন ভাবে সরকারের আরো উদার নীতি গ্রহন করার প্রয়োজন । গ্রাম্য কৃষি উন্নয়নে শিক্ষিত মেয়েদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো, স্বাস্থ্যখাতে মেয়েদের আরো সম্পৃক্ততা এবং শিক্ষার হার বাড়ানোতে মেয়েদের মেধা কাজে লাগিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করায় মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে । মেয়েদেরকে এবং অসহায় পরিবার সমুহকে বাল্য বিবাহ থেকে মুখ ফেরাতে হলে অবশ্যই মেয়েদের আত্ননির্ভরশীল করার প্রতি জোর দিতে হবে । এজন্য গ্রামে গ্রামে কারিগরি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষন পদ্ধতি চালু করা খুবই কার্যকরি পদক্ষেপ হতে পারে । ইলেক্ট্রনিক পন্যের প্রসারে কারিগরি শিক্ষা সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হতে পারে মেয়েদের আত্ননির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে ।
শেষ কথাঃ
দিন বদলের অঙ্গীকার রয়েছে ২০২১ সালের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৫৪ থেকে কমিয়ে ১৫ করা হবে৷ ২০২১ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩.৮ থেকে কমিয়ে ১.৫ করা হবে৷ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা না গেলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না৷ বাল্য বিবাহ সংকুচিত করে দেয় কন্যা শিশুর পৃথিবী৷ আমরা যদি সবাই সচেতন হই তাহলে কন্যা শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে৷ দেশে মা ও শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হবে৷ সমাজের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের; বিশেষ করে আমাদের রাষ্ট্এবং প্রশাসনকে এ ব্যাপারে সবার আগে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে ।
loading...
loading...
আমি তো পড়ে অনেক তথ্য পেলাম। এরুপ পোষ্ট এর আবশ্যকতা অনেক।
loading...
বাল্য বিবাহ নিবারণ করার জন্য আইন তৈরী করে সুফল হবে না। ঠিক বলেছেন। তবে প্রয়োজন প্রয়োগ। প্রয়োজনের জায়গায় না রেখে যোগ্য শাসনে আদায় করতে হবে।
loading...