আজ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কোনটাই না। কিন্তু মানিক বাবু এমন একজন যাকে নিয়ে জন্মদিন বা মৃত্যুদিন ছাড়াও যেকোন দিন আলোচনা করা যায়। সব লিখকই লিখার জন্য ভেতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করেন। সেই তাগিদ থেকেই তাঁদের লিখা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন লিখতেন? তাঁর উত্তর তিনি দিয়েছেন কেন লিখি নামে এক প্রবন্ধে। ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে কেন লিখি শিরোনামে একটি সংকলন বের হয়েছিল। সেখানেই বের হয়েছিলে মানিকের এই প্রবন্ধ। ‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি।’ আমার প্রিয় লেখকদের একজন মানিক। তাঁর সৃষ্টি বিষ্ময় ঘোর নিয়ে আমি পড়ি। আজ তাই মানিকের সেই লেখাটি হাজির করলাম আপনাদের জন্য। বেশি বক বক না করে সরাসরি তাঁর কাছেই আপনাদের নিয়ে যাই।
কেন লিখি
–মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখক হবার ইচ্ছে সম্বন্ধে হঠাৎ সচেতন হইনি। স্কুল জীবনের শেষের দিকে ইচ্ছেটা অল্পে অল্পে নিজের কাছে ধরা পড়েছিল। কিন্তু সে ইচ্ছে হাত মেলেছিল বহু দূরের ভবিষ্যতে – সঙ্গে সঙ্গে লেখবার তাগিদ যোগায়নি। অধিকাংশ স্কুল কলেজে হাতে লেখা মাসিকপত্র থাকে। সারা বাংলায় ছড়ানো গোটা দশেক স্কুলে আর মফস্বল ও কলকাতায় গোটা তিনেক কলেজে আমি পড়েছি। লিখবো? এই বয়স আমার। বিদ্যাবুদ্ধি অভিজ্ঞতা কিছু আমার নেই। কোন ভরসায় আমি লিখবো? লেখা তো ছিনিমিনি খেলা নয়। বাড়িতে লুকিয়ে লেখার চেষ্টাও আমি কখনও করিনি। আমার অধিকার নেই বলে।
১৩৩৫ সালেও – যে বছর আমি প্রথম লেখা লিখি, – আমার এ মনোভাব বদলায়নি। বরং আরও স্পষ্ট একটা পরিকল্পনা হয়ে দাড়িয়েছে। বয়সের সীমা ঠিক করেছি। তিরিশ বছর বয়সের আগে কারো লেখা উচিত না – আমি সেই বয়সে লিখবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে সব দিক দিয়ে। কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নয়। নিশ্চিন্ত মনে যাতে সাহিত্য চর্চা করতে পারি তার বাস্তব ব্যবস্থাগুলোও ঠিক করে ফেলবো।
হ্যাঁ তখন আমার বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক পড়েছে। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? তখনও বিশ্বাস করিনি, আজও বিশ্বাস করি না যে, বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের বিরোধ আছে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সম্বন্ধ এযুগের অতি প্রয়োজনীয় যুগধর্ম।
স্বীকার করছি, ১৩৩৫ সালে এসব তত্ত্বকথা মানতাম না – অস্পষ্ট অনুভূতি ছিল মাত্র। কিন্তু বিজ্ঞান-প্রেমের সঙ্গেই দৃঢ়তর হতো লেখার সঙ্কল্প। কলেজ থেকে তখনকার বালিকা-বালীগঞ্জের বাড়িতে ফিরতাম, আলোহীন পথহীন অসংস্কৃত জলার মতো লেকের ধারে গিয়ে বসতাম – চেনা অচেনা কোন একটি প্রিয়ার মুখ স্মরণ করে একটু চলতি কাব্যরস উপলব্ধি করার উদ্দেশ্যে। ভেসে আসতো নিজের বাড়ির আত্মীয়-স্বজন আর পাড়াপড়শীর মুখ, জীবনের অকারন জটিলতায় মুখের চামড়া যাদের কুচঁকে গিয়েছে। ভেসে আসতো স্টেশনে ও ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের মুখ – তাদের আলাপ আলোচনা, ভেসে আসতো কলেজে সহপাঠীদের মুখ – শিক্ষার খাঁচায় পোরা তারুণ্য-সিংহের সব শিশু, প্রাণশক্তির অপচয়ের আনন্দে যারা মশগুল। তারপর ভেসে আসতো খালের ধারে, নদীর ধারে, বনের ধারে বসানো গ্রাম – চাষী, মাঝি, জেলে, তাঁতিদের পীড়িত ক্লিষ্ট মুখ। লেকের জনহীন স্তব্ধতা ধ্বনিত হতো ঝিঁঝির ডাকে, শেয়াল ডেকে পৃথিবীকে স্তব্ধতর করে দিতো, তারারা চোখ ঠারতো আকাশের হাজার ট্যারা চোখের মতো, কোনদিন উঠতো চাঁদ। আর ওই মুখগুলি – মধ্যবিত্ত আর চাষাভূষো – ওই মুখগুলি আমার মধ্যে মুখর অনুভূতি হয়ে চ্যাঁচাতো – ভাষা দাও – ভাষা দাও।
আমি কি জানি ভাষা দিতে?…
…একদিন কলেজের কয়েকজন বন্ধু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছে। আলোচনা গড়াতে গড়াতে এসে ঠেকলো মাসিকপত্রের সম্পাদকের বুদ্ধিহীনতা, পক্ষপাতিত্ব, দলাদলি প্রবণতা ও উদাসীনতায়। বললাম, ‘কেন বাজে কথা বকছো? ভালো লেখা কি এত সস্তা যে, হাতে পেয়েও সম্পাদকেরা ফিরিয়ে দেবেন? মাসিকগুলি তো পড়ো, মাসে ক’টা ভালো গল্প বেরোয় দেখেছো? সম্পাদকেরা কি পাগল যে, ভালো গল্প ফিরিয়ে দিয়ে বাজে গল্প ছাপবে? ভালো দূরে থাক, চলনসই একটা গল্প পেলে সম্পাদকেরা নিশ্চয় সাগ্রহে ছেপে দেয়।’
অনেক কথা কাটাকাটির পর বাজি রাখা হলো।
বাজি হলো এই। আমি একটি গল্প লিখে তিন মাসের মধ্যে ভারতবর্ষ, প্রবাসী বা বিচিত্রায় ছাপিয়ে দেবো। যদি না পারি – সে কথা আর কেন?
আমি জানতাম পারবো। কোনদিন এক লাইন লিখিনি, কিন্তু গল্প তো পড়েছি অজস্র। সাহিত্য হবে না, সৃষ্টি হবে না, কিন্তু সম্পাদক ভোলানো গল্প নিশ্চয় হবে। আমি কেন, যে কেউ চেষ্টা করলেই একরকম গল্প লিখতে পারে।
তখন মনে পড়লো পূর্ববঙ্গের এক স্বামী-স্ত্রীর কথা। বাস্তব জীবনে নাটকীয় প্রেমের চরম অভিজ্ঞতা ওদের দেখেই আমি পেয়েছিলাম। স্বামী বাশিঁ বাজাতেন। বাঁশের বাঁশি নয়, ক্ল্যারিওনেট। প্রায় পায়ে ধরে তাঁকে আসরে বাজাতে নিয়ে যেতে হতো – গিয়েও খুশি হলে বাজাতেন, নইলে বাজাতেন না। বাড়িতে বাজাতেন – স্ত্রীকে শ্রোতা রেখে। বছরখানেক আমি শুনেছিলাম। বেশিক্ষন বাজালে তাঁর গলা দিয়ে রক্ত পড়তো।
এদের অবলম্বন করে এক ঘোরালো ট্র্যাজিক প্লট গড়ে তুলে গল্প লিখলাম। নাম দিলাম অতসী মামী। ভাবলাম, এই উচ্ছা্সময় গল্প, এই নিছক পাঠকের মন ভুলানো গল্প, এতে নিজের নাম দেবো না। পরে যখন নিজের নামে ভালো লেখা লিখবো, তখন এই গল্পের কথা তুলে লোকে নিন্দে করবে। এই ভেবে বন্ধু ক’জনকে জানিয়ে, গল্পে দিলাম ডাক নাম – মানিক। কল্পনাশক্তি একটা ভালো ছদ্মনামও খুঁজে পেলো না।
বাংলা মাসের মাঝামাঝি। বিচিত্রা আপিসে গিয়ে গল্পটা দিয়ে এলাম।
একদিন সকালে ভাবছি, কলেজে যাবো কি যাবো না। একজন ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন। আমার ‘অতসী মামী’ গল্পের জন্য পারিশ্রমিক বাবদ নগদ টাকা হাতে তুলে দিয়ে দাবী জানালেন, আর একটি গল্প চাই।
তারপর সব ওলোট পালট হয়ে গেল। সব ছেড়ে দিয়ে আরম্ভ করলাম লেখা।
হঠাৎ একটা গল্প লিখে মাসিকে ছাপিয়ে কি কেউ লেখক হতে পারে? হাত মক্স করতে হয় – কঠিন সাধনায় জীবনপাত পরিশ্রমে মক্স করতে হয়। কেরানীর বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোট খাটো লেখকও লেখক হতে পারেননি। হঠাৎ কি কেউ লিখতে শেখে, না পারে? সাহিত্য সাধনার জিনিস। এ সাধনার সূত্রপাত কি ভাবে হয় অনেক সাহিত্যিকের জীবনে তার চমকপ্রদ উদাহরণ আছে। আজ সাহিত্যিক মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘প্রথম লেখা’ লিখবার কাহিনীতে তার একটা নমুনা পাবেন।
এখনো আত্মীয়স্বজন আপসোস করেন, ‘তোর দাদা লেখাপড়া শিখে দু’হাজার টাকার চাকরি করছে, তুই কি করলি বলতো, মানিক? – না একটা বাড়ি, না একটা গাড়ি – ‘আপনারা কি বলেন?…
loading...
loading...
‘লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে কথা জানানো যায় না
সেই কথাগুলি জানাবার জন্যই আমি লিখি।’
___ এই হলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা !!
loading...
ঠিক বলেছেন স্যার। এই হল বড় লেখকদের সাথে আমাদের তফাৎ। সেই প্রকাশও কি এত সহজ! মানিক বাবুরর ভাষায়:
হাত মক্স করতে হয় – কঠিন সাধনায় জীবনপাত পরিশ্রমে মক্স করতে হয়। কেরানীর বেশি খেটে লিখতে না শিখে জগতে আজ পর্যন্ত একটি ছোট খাটো লেখকও লেখক হতে পারেননি। হঠাৎ কি কেউ লিখতে শেখে, না পারে? সাহিত্য সাধনার জিনিস।
loading...
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে জেনে ছিলাম সেই স্কুল পড়ুয়া সময়কালীন। সম্ভবতঃ প্রবন্ধটি ছিল পদ্মা নদীর মাঝি নামে। আজ অনেকদিনপর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে নতুন একটি তথ্য জানতে পারলাম।
ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। মানিক বাবুর কাছ থেকে অনেক কিছুই জানার আছে, আছে অনেক কিছু শেখার। শুভ কামনা সতত।
loading...
আপনাকে বহুত বহুত ধন্যবাদ।

ল
loading...
আপনাকে পাইয়া আমারও দিল বহুত খুশ হইল।
আপনাকেও ম্যালা শুভেচ্ছা।
loading...
আরে ভাই বাড়ির কাছে খালিদ উমর থাকতে অতদূর থেকে মানিক বাবুকে টেনে আনলেন কেন?
পারলে খালিদ উমর সম্পর্কে কিছু লেখেন!
loading...
একদম ঠিক কথা বলেছেন খালিদ ভাই।
এর পরের লিখা হবে খালিদ উমর কেন লিখেন সে নিয়ে, কি বলেন?
সুতরাং লিখে ফেলেন, ‘কেন লিখি’ — খালিদ উমর। আর আমি সেটারে কপি পেস্ট কইরা দিই।
loading...
সাহিত্য সাধনার জিনিস। একদম । সাধনা আর সাধনা । অবশ্য ভেতরে মাল মসলাও থাকতে হয় যা স্রষ্টা প্রদত্ত । এই যে প্রতিভা সৃষ্টি হয় একে তৈরী করা যায় না । যেমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পড়াশোনা করলেই হোয়া যায় কিন্তু একজন মানিকের সৃষ্টি করেন স্বয়ং স্রষ্টা । সে অন্যজন হাজার জীবন সাধনা করলেও পারবে না ।
ধন্যবাদ আনু ভাই আপনার মূল্যবান এই পোস্টটির জন্য ।
loading...
ধন্যবাদ প্রিয় আপু।
ঠিক বলেছেন দুয়ের মিশেলেই সাহিত্য হয়।
loading...