ভাষার বিকৃতি, ভাষার আরাধনা

বাংলাদেশে একটি শব্দ খুবই পরিচিত। ‘আর-জে’। রেডিও জকি। বাংলাদেশে একটি ব্যাপক বিপ্লব ঘটিয়েছে এফএম রেডিও। এই খবরটি অনেকটাই তলিয়ে যেতে বসেছে। এর কারণ, মানুষ এখন টিভি, ইন্টারনেট নিয়েই ব্যস্ত। ব্যস্ত ফেসবুক, টুইটার নিয়ে। তারপরও তরুণ প্রজন্মের মাঝে একটা ক্রেজ তৈরি করেছে এই রেডিও ব্যান্ড। তার একমাত্র কারণই ওই রেডিও জকির নতুন নতুন ভাষ্য।

প্রিয় পাঠক, আপনারা কি সেই ভাষ্য মাঝেমধ্যে শোনেন? কী বলেন এই রেডিও জকিরা? তারা কি বাংলা বলেন? কোন বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন তারা? বাংলার সঙ্গে ইংলিশ মিলিয়ে একটা ভাষা তৈরি হয়েছে বেশ আগেই। কেউ বলেন, ‘বাংলিশ’, কেউ বলেন ‘বাংরেজি’। এই বিষয়টি সম্প্রতি আবার সামনে এসেছে। এ নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন- ‘নতুন প্রজন্মের ইংরেজি ঢঙে বাংলা বলার প্রবণতা ছাড়াতে কী করা যায়, সে পথ বের করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কথ্য ভাষা বলব, ঠিক আছে। দয়া করে আমাদের ভাষার যে প্রচলিত ধারা সেটাকে এভাবে বিকৃত করে .. বাংরেজি বলে ফেলছি; এটা যেন আর না হয়। এদিকে একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এটা ছেলেমেয়েদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ওইভাবে কথা না বললে তাদের মর্যাদাই থাকে না। এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে। যখন যেটা বলবে, সেটা সঠিকভাবে বলবে, সঠিকভাবে উচ্চারণ করবে, সঠিকভাবে ব্যবহার করবে।’

প্রধানমন্ত্রী ১৯৫২-এর ভাষা শহীদদের স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এই ভাষা আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। এর মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েদের এই ভাষা শিখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘এই ইনস্টিটিউট একদিন তাদের গবেষণা, ভাষা সংরক্ষণ, ভাষা সম্পর্কে আরো জ্ঞান সংরক্ষণ করবে। প্রত্যেকটা ভাষার উৎস কী, কীভাবে বিকশিত হলো, কীভাবে ভাষা বিভিন্ন জাতির কাছে এলো, তা নিয়ে গবেষণার আধার হয়ে উঠবে। আমরা সেভাবে এই ইনস্টিটিউটকে গড়ে তুলতে চাই। আশা করি, বিশ্বের বুকে একদিন এই ইনস্টিটিউট আলাদা মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে।’ প্রধানমন্ত্রী মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলা ভাষাভাষীর স্থান ষষ্ঠ। সেই হিসাবে জাতিসংঘের একটি ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করে কিনা- এ ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। যদিও এটা কার্যকর করতে অনেক রকম সমস্যা আছে। তবুও আমরা আমাদের দাবিটা তুলে রেখেছি। আমরা দাবিটা একদিন বাস্তবায়ন করতে পারব।’

প্রধানমন্ত্রীর এই আশাবাদের যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। বাংলা ভাষাভাষীরা এখন বিশ্বে দাঁড়াচ্ছেন মাথা উঁচু করে। তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন, একাত্তরের শৌর্য-বীর্যের ধারাবাহিকতা। কিন্তু এই বাংলাদেশেই একটি শ্রেণি বাংলা ভাষাকে নিয়ে এমন মশকারা করছে কেন? ‘দৈনিক শ্রমিক কণ্ঠ’ নামের একটা কাগজের প্রথম পাতা ছবিসহ ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে তারা মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে বলেছে- ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই কাগজের সম্পাদক কে? এখানে কারা সাংবাদিকতা করেন? এমন চিত্র বাংলাদেশে বাড়ছেই। টিভিতে দেখলাম, নতুন প্রজন্মের কেউ কেউ বলছে, তারা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানাতে শহীদ মিনারে এসেছে! এরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। এদের কি শেখানো হচ্ছে? কারা তা শেখাচ্ছেন?

একুশের চেতনার সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির সম্পর্ক খুবই প্রগাঢ়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল বাংলায়। সেটি ছিল নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশন। অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আবদেল আজিজ বুতেফ্লিকা। সভাপতি ‘বাঙালি জাতির মহান নেতা’ হিসেবে পরিচিতি জানিয়ে বক্তৃতা মঞ্চে আহ্বান করেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু সদর্পে বীরোচিত ভঙ্গিমায় আরোহণ করেছিলেন বক্তৃতা মঞ্চে। প্রথম এশীয় নেতা, যিনি এই অধিবেশনে সবার আগে ভাষণ দিয়েছিলেন। দৃপ্ত পায়ে বক্তৃতা মঞ্চে উঠে ডায়াসের সামনে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। মুহুর্মুহু করতালি। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করেন মাতৃভাষা বাংলায়। যে ভাষার জন্য ঢাকার রাজপথে বাঙালি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। সেই ভাষায় প্রথম ভাষণ জাতিসংঘে। বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে আবার ঠাঁই করে দিলেন। এর আগে ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে বিশ্ববাসী জেনেছিল বাংলা ভাষার উজ্জ্বল অক্ষরগুলো। এর ষাট বছর পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে উচ্চারণ করলেন বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার অমর শব্দগুলো। জাতিসংঘে বিশ্বের সব নেতা নিজ নিজ মাতৃভাষাতেই ভাষণ দিয়ে থাকেন। জাতিসংঘের সরকারি ভাষা ছয়টি- ইংরেজি, ফরাসি, রুশ, চীনা, স্প্যানিশ ও আরবি। এই ৬ ভাষাতেই বক্তৃতা রূপান্তরিত হয়ে থাকে। আমরা আজ সেখানেই আমাদের বাংলা ভাষাকে যুক্ত করার প্রচেষ্টা করছি জোরালোভাবে।

আমার মনে পড়ছে, ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন বলেছিলেন, ‘যে ভাষার জন্য সংগ্রাম হলো, জীবন দিতে হলো সেই বাংলা এখনো সর্বস্তরে চালু হয়নি- এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, বাঙালিদের ভালো করে ইংরেজি শিখতে হলেও বাংলা জানতে হবে। কারণ ভালো বাংলা ছাড়া ভালো ইংরেজিও শেখা যাবে না।’ ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম সমাবর্তন বক্তৃতায় আব্দুল মতিন বলেছিলেন, ‘সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভাষাবিদ, রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনের দেয়া রিপোর্ট ও সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।’ তার আশাবাদ ছিল- ‘আমরা ১৯৫২ সালে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, ১৯৭১ সালে যে স্বপ্ন বুকে ধারণ ও লালন করেছিলাম, তা আজো পূরণ হয়নি। আজকের তরুণ ছাত্ররাই পারে সেই অপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। তার জন্য দরকার অবারিত দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ।’

এই কথাগুলো আজকের প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে। আজ আঞ্চলিক ভাষার কথা বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভাষা বেশ শুদ্ধ। এরকম বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই আলাদা আলাদা আঞ্চলিক ভাষাগুলো আমাদের ভাষাকে আরো প্রাচুর্যময় করেছে। আঞ্চলিক ভাষা আমাদের ভাষা থেকে হারিয়ে যাবে না। তারপরও ভাষার শুদ্ধতার জন্য যেমন কাজ করা দরকার তেমনি এর আঞ্চলিক ভাষাগুলোর সংরক্ষণ করাও আমাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে। কালের আবর্তে আমরা প্রমিত ভাষার চর্চা করে যাবই। কিন্তু ইচ্ছা করলেই আঞ্চলিকতাকে আজই শুদ্ধ হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযেগ্য করা সম্ভব হবে না। তা সম্ভবও নয়। কিছু আঞ্চলিকতা বাংলা ভাষাকে আরো বেশি মধুর করে তুলেছে আমাদের মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে। কত বিচিত্র এই বাংলা ভাষা। বিচরণ না করলে কখনই বোঝা যাবে না বাংলা ভাষা বলার ভঙ্গিমায় কী রকম আলাদা আলাদা ব্যকুলতা রয়েছে। যা আমাদের কথা বলার আত্মতৃপ্তি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আরো যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার, এই ভূখণ্ডে আরো অনেক জাতি-গোষ্ঠীর বাস আছে। তারাও তাদের মায়ের ভাষায় কথা বলবে, পড়ালেখা করবে, সংস্কৃতির চর্চা করবে। বাঙালি সেদিন স্লোগান তুলেছিল- ‘বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা চাই’। এখানেই বাঙালির ভাষা সংগ্রামের অনন্যতা। তার সংগ্রামে কোনো উগ্র জাতীয়তাবাদ কিংবা জাতিগত সংকীর্ণতার চিন্তা স্থান করে নিতে পারেনি। কিন্তু ব্যর্থতাও আছে।

আমরা কি পেরেছি প্রতিটি বাঙালি সন্তানকে তার নিজের মাতৃভাষাকে চেনাতে, জানাতে, পাঠে সক্ষম করতে? আমরা কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বর্তমান প্রজন্মের মননে-ধ্যানে-অনুশীলনে বাংলা ভাষাকে বিশেষ স্থান করে দিতে পেরেছি? পেরেছি কি বাংলাদেশের ভাষাভাষী মানুষকে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার দিতে? একজন বাঙালির সন্তানেরা যদি জন্মের পর তার নিজের ভাষায় কথা বলার, সেই ভাষাতেই লেখাপড়া করার অধিকার থাকে তাহলে একজন আদিবাসী সন্তান কেন তার মাতৃভাষায় শিক্ষিত হতে পারবে না? বায়ান্নর ৬৫ বছর পর আজো কেন সমাজে শ্রেণিবৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রহীনতা দেখতে হবে? বাংলা ভাষার আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম আজ সারাবিশ্বেই স্বীকৃত। মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে একুশ যে আজ আন্তর্জাতিক দিবসে পরিণত হতে পেরেছে তার মূল কারণই হচ্ছে এই সংগ্রামের আত্মার মধ্যে কোনো উগ্রজাতি বিদ্বেষ বা জাতীয় সংকীর্ণতা ছিল না। আমরা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষার বিকাশের পক্ষেই ছিলাম। আমরা সেই ভাষার আরাধনা চাই। ভাষার বিকৃতির রোধ চাই। চাই মানুষ দাঁড়াবে ভাষার শক্তি নিয়ে। শুদ্ধ ভাষার চর্চা করে। সঠিক ইতিহাস চর্চা করে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই নয়, বছরজুড়ে ভাষার চর্চা হোক পরিশুদ্ধভাবে। আসুন আমরা এই ধ্যানে ও মননে ঐক্যবদ্ধ হই।

______________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ। ঢাকা। শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. ফকির আবদুল মালেক : ২৮-০২-২০১৭ | ৭:৫৬ |

    ধন্যবাদ লেখাটি এখানে শেয়ার করার জন্য।

    শুভ কমনা রইল।

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ২৮-০২-২০১৭ | ১৩:৩৩ |

    আমরা বাংলা ভাষার আরাধনা চাই। ভাষার বিকৃতির রোধ চাই। চাই মানুষ দাঁড়াবে ভাষার শক্তি নিয়ে। শুদ্ধ ভাষার চর্চা করে। সঠিক ইতিহাস চর্চা করে। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই নয়, বছরজুড়ে ভাষার চর্চা হোক পরিশুদ্ধভাবে। সহমত।

    GD Star Rating
    loading...
  3. নীল সঞ্চিতা : ২৮-০২-২০১৭ | ১৪:৩২ |

    আরজে দের অত্যাচারে এফএম রেডিও তে কান পাতা দায়। এর চেয়ে বাংলাদেশ বেতারই ভাল।
    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ লেখাটি আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন বলে।

    GD Star Rating
    loading...
  4. মিতা : ২৮-০২-২০১৭ | ১৬:০০ |

    বিদেশে থেকে দেখেছি আমার এখানে ওদের রেডিও জকি বলা হয় না । ডিজে-ই বলা হয়।
    আমাদের দেশের এই ডিজে দের ডিজে সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই । বছর দুই আগে আমি বাংলাদেশের এফ এম রেডিওতে ওদের কথা শুনে স্রেফ লুচ্চামি (দুক্ষিত) ই মনে হয়েছে ।
    ঘোড়ার জকিরা অনেক ভালো এদের চেয়ে …

    GD Star Rating
    loading...