পোকা পোকা

এক

আলো তোমার মুখের পর্ব ও পর্বমধ্যে পড়ে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছিল, না মুখটাকে শুধরে দিচ্ছিল আলো — আমি বুঝতে পারিনি। যেভাবে মূর্তিকার প্রতিমার কানের লতির বাড়তি মাটিটুকু ঝরিয়ে দেয়, হাতের নরুন আধাবৃত্ত ঘুরিয়ে ফুটিয়ে তোলে নাকের পাটা, আলো কি এভাবে সংরক্ষণ করতে চাইছিল তোমাকে!

তোমার ভঙ্গি বিন্যস্ত, যেমন প’রে থাকা ফিরোজা-রঙ তসরের ভাঁজের পর ভাঁজ কোমরে, থাকের পর থাক বুকের কাছটায়।

তার আগে তুমি ব্যস্তসমস্ত ছিলে — যখন আবির্ভাব। ব্যাঁকাচোরা ভিড়ের গলি ঠেলে এগিয়ে আসছ, কানে মোবাইল এবং লরজদার তানের মতো জমজমাট দুলও, যা শুধু ফোন সরে যাবার পরে দৃশ্যমান হবে। আর যে দাঁড়িয়ে আছে থতমত, লন টেনিসের দর্শক — ডানদিক-বাঁদিক ঘাড় ঘোরাচ্ছে কখন সেই ম্যাচ পয়েন্টের দেখা; কখন নায়িকার মঞ্চে প্রবেশ, উইংসের এদিক না ওদিক দিয়ে; কেননা মঞ্চ হল নাগের বাজারে বাটার দোকানের ফুটপাথ, প্রচুর ধাক্কা ও সরি-বিশিষ্ট।

[ঠিক আছে, এতগুলো সরি যখন হজম করেছে, আরেকটাও পারবে। আমি তো আধঘন্টা আগেই এসে পড়েছিলাম। তারপর দুএকটা কাজ সেরে ফিরে খেয়াল হল, সে-ও পূর্বাহ্নে পৌঁছে দাঁড়িয়ে। তো, দেখলাম। ফেসবুকে, হোয়াটস্যাপে ছবি রাখেনি, এমন তো নয়। তবু এক পলকের একটু কিশোরকুমারের কী দরকার ছিল! আসলে সে চেয়েছে, আমিও ভাবলাম, আজ সময় বের করা যেতে পারে। আচ্ছা, চাওয়া মানে আকাঙ্খা করা, আবার তাকানোও। কথাটা আগে মনে হয়নি!]

তুমি অপাঙ্গে দেখলে বাঁচোখের কোন দিয়ে। কটাক্ষ নয়, হুড়মুড় করে দেখা। যেন এভাবে কত-কত দিন মিট করে আমরা পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্যে দিকবিদিক দৌড়ে গেছি, অথবা আমাদের গীতিনাট্যের ফাইনাল রিহার্সালে আজ অলরেডি দশ মিনিট লেট!

আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নকল অন্যমনস্কতা মিশিয়ে তার আড়ালে বুকের ধুকপুকুনি চাপা দিয়ে রেখেছ? হয়তো সব পুরুষই এভাবে ভাবতে ভালোবাসে। তুমি উঠে গেছ পরিচিত দোকানের কাউন্টারে দুটো কফি ব’লে আসতে। তার আগে উলটো দিকের চেয়ার থেকে আমার খুব সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলে। শরীরে বৃষ্টি ভ’রে নেওয়া মাটি, বা এক-ফুট দেওয়া ভাতের পাত্র থেকে যেমন একটা ভাপ বেরোয়, তোমার দাঁড়ানো থেকে বিকিরণ উৎপন্ন হয়ে আমার ভেতরে যাচ্ছিল। কিছু জিগেস করছিলে আর প্রত্যেকটা প্রশ্নের সঙ্গে তোমার মাথা ঝুঁকে আসছিল আমার দিকে — সবুজ ডাঁটির মাথায় চন্দ্রমল্লিকা! খয়েরি চশমার পেছনে তোমার চোখ, কপালে দোলনা-চাপা চুলের পেছনে তোমার চোখ, টানটান গালের ছোট লাল বিজকুড়ির পেছনে তোমার চোখ — এত পুঞ্জাক্ষি সবাই গণসঙ্গীতের মতো একযোগে কিন্তু হারমনির মতো নানারকম স্বরে কথা বলছিল কেন! একজন: এ-মা, তুমি এই শ্যামলা মেয়েকে শুকতারা বলে ডাকো!
আর একজন: এই বৃষ্টিতে বোলপুরে যাবে? বাঁদরলাঠি ফুলে ছাওয়া মাঠের পাশে রাস্তায় দুজনে হাত ধরে হাঁটব…।

আমার বুকের মধ্যে অগাধ পায়রা উড়ছিল…।

[যত জিগেস করি, চা না কফি কোনটা পছন্দ, ততবার — আপনি যা নেবেন তাই। এত বাধ্য ছেলে যে হাসি পেয়ে যাচ্ছে! মুখ তুলে রেখেছে এমন, যেন স্বাতী তারা খুঁজবে রেস্তোরাঁর ছাদে। ইচ্ছে করে, থুতনি ধরে নাড়িয়ে দিই; না, নাকটা বেশ ক’রে; নাকি…!]

দুই
আবার আলো ফুঁ দিচ্ছে তোমার চোখের তারায়, নাকের বাঁশিতে, কানের লতির সারিন্দায়, আর সুর বেজে উঠতে দেখছি। তুমি পাহাড়-চোঁয়ানো জলঝারির শব্দে কথা বলে যাচ্ছো … যে, কোন গান কোন স্টুডিওতে রেকর্ড করলে এই বছর; যে, তোমার ছেলে কত ভালো স্প্যানিশ গিটার শিখছে, তার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষাও; তোমার বরেতে তুমিতে মিলে কতখানি বিপদসংকুল বোলেরো চালিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে যেতে পার। শোনো, এখানে আমি একটু গলা খাঁখারি দিয়ে বললাম: আমিও কিন্তু খুব ভালো হিন্দি শিখেছি। উদাহরণ হিসেবে, লতা মঙ্গেশকারের যে গানটা বাজছে রেস্তোরাঁয়, দো নয়নোঁ মেঁ আসুঁ ভরে, এর বাংলা হল, তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল। বা, উলটো দিকে ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’-র হিন্দি অনুবাদ কী যদি আমাকে প্রশ্ন করো, দেখবে তৎক্ষণাত উত্তর দিচ্ছি, কঁহী দূর যব দিন ঢল যায়েঁ। শুনে তুমি কফির কাপ টেবিলে নামিয়ে চেয়ারে পিঠ, হাসতে লাগলে। দুহাত উঠে এল মাথার পেছনে খোঁপা ঠিক করার মুদ্রায়, যা আসলে একটা বে-দম ‘আর পারছি না গো’ ভঙ্গি, আর আমি দেখলাম বাঁ দিকের শাড়ি সরে গিয়ে মুখ বাড়িয়েছে খাঁচার পাখি — তোমার বুক। ঠোঁটটেপা হাসি তার মুখেও।

[তারপর জোর করতে লাগল, যেন স্যান্ডউইচ থেকে একটুখানি খাই। এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, আয়্যাম ফুল টু দ্য ব্রিম ব’লে। বলে কি, হুঁ হুঁ বাবু, আমি ইংরাজিও জানি। স্যান্ডউইচের বাংলা কী শুনবে? বালির ডাইনি!
তারপর আর কিচ্ছু বুঝতে না দিয়ে ওই একই নিঃশ্বাসে, আমাকে ভালোবাসো, শুকতারা?
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, পোকা পোকা।
ঠিক এইভাবে মহম্মদ রফি ফাঁসিয়েছিলেন লতা মঙ্গেসকারকে। বাগোঁ মেঁ বহার হ্যায় গানটাতে নানা আগডুম বাগডুম প্রশ্ন করতে করতে হঠাৎ তুমকো মুঝসে প্যার হ্যায়?

দেবত্র, আমার ছেলে বলে, স্প্যানিশে পোকা মানে — একটু। আমি কি একটু বড়ই ভুল করে ফেললাম? কিন্তু এখন শোধরাতে যাওয়াটা বোকা-বোকা হয়ে যাবে। অসুবিধে নেই, সন্ধেবেলা মেসেজে জানিয়ে দেব, ওটা জাস্ট ইয়ারকি ছিল। আমি যদি এ-জীবনে কাউকে ভালোবেসে থাকি, সে ধৃতিমান, আমার হাবি।]

আর হয়তো দশ মিনিট বসব আমরা, তোমার ডান হাতের কব্জি বলছে। কিন্তু তোমার করতল কী ভাবছে মনে মনে, এখনও জানা হয়নি! ওহ, এ আর এমন কি ব্যাপার — ব’লে তুমি দুহাত কোরকের মতো ছড়িয়ে দিলে টেবিলের ওপর, যেভাবে হাঁটু মুড়ে বসে মুখ দেখে নামাজি। আমিও ঝুঁকে পড়ে দেখতে পেলাম প্রচুর ইতিহাস, নানা সৌধ ও তার ভাঙন, উটের পিঠে মসলিন চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ার বাণিজ্যপথ, বল্লম-ত্রিশূলে ঘেরা যুদ্ধশিবির…অথচ তার পরেও বেঁচে থাকা অনামিকার নিচে মসৃন টিলা, বুড়ো আঙুলের পাশে আর্ত ঘাসজমি।

এদিকে তাকাও, ডান হাত পাতো — হালকা ধমক কানে এল। আমিও মন্ত্রপিপাসিত, হাত চিৎ করেছি টেবিলে, আর ওমনি, যা অবিস্মরণীয় তাই ঘটল; অথবা, যা ঘটল, তাকে আমরা অনপেক্ষিত শিরোপা দিই। তোমার বাঁহাত উপুড় করে রাখলে আমার ডানহাতে। সেই স্পর্শে এসে স্পর্শ শব্দ থেমে গেল। পাঁচটা ইন্দ্রিয় থেকে কানের সোনার মতো অন্যমনস্ক খসে পড়ল ছোঁয়ার অনুভূতি। দেখলাম, দুধসাদা বেড়ালের শরীরের মতো; চিরহরিৎ জঙ্গলের পায়ের কাছে পদাতিক মেঘ জমে তৈরি হওয়া ঘাসের মতো; দোয়েল, পাপিয়া, টিয়া, মৌটুসি, তিতির — পাঁচ আঙুল-পাখির নখরহীন উড়ে বসার মতো তোমার হাত। তার নিচে তাকিয়ে নিজের করতলের দেখা পেলাম কই! সেখানে বালি-রঙের, কানায় গেরুয়া রেখা-টানা একখানি মাটির সরা রয়েছে। ভেতরে তুমি — জ্বলন্ত কর্পূর, সাদা, স্বচ্ছ, নিধূম, সহনশীল আগুন। আমার উচিত এই বিরল বহ্নিকে হাতের আড়াল দেওয়া ভেবে আরেকটা মাটির সরা, যা আসলে আমার বাঁ হাত, ওর ওপর উজাড় করলাম।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৫-০২-২০১৭ | ১৪:৫০ |

    মনে হলো যেন জীবন থেকে কথাকলির ছায়া। সত্যও হতে পারে কে জানে !! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

    এমন ঝরঝরে অনবদ্য লিখন পাঠক হৃদয় ছোঁবে না এমনটা আমি বিশ্বাস করি না।
    জীবন সাহিত্যের অনন্য উদাহরণ লিখাটি। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা। গ্রেট।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. দাউদুল ইসলাম : ১৫-০২-২০১৭ | ১৯:২১ |

    তোমার ভঙ্গি বিন্যস্ত, যেমন প’রে থাকা ফিরোজা-রঙ তসরের ভাঁজের পর ভাঁজ কোমরে, থাকের পর থাক বুকের কাছটায়।

    ভালো লাগল লিখাটি
    ভীষণ এক সত্যের খুব সুন্দর উপস্থাপন;
    প্রীতিময় শুভেচ্ছা ও ভালবাসা –

    GD Star Rating
    loading...
  3. মামুন : ১৫-০২-২০১৭ | ২২:৩৬ |

    জীবন ঘনিষ্ঠ অনন্য লেখায় মুগ্ধতা, চন্দন দা’।

    শুভেচ্ছা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. রিয়া রিয়া : ২২-০২-২০১৭ | ৭:৪৬ |

    শুভেচ্ছা নিন কবি।

    GD Star Rating
    loading...